কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলায় ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা, শান্তির আহ্বান জানাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
জম্মু ও কাশ্মীর সীমান্তে সম্প্রতি পর্যটকদের ওপর সন্ত্রাসী হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশ দুটিকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত সপ্তাহে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে হওয়া এই হামলার পর, দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে ওয়াশিংটন এই পদক্ষেপ নিয়েছে।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে জানান, যুক্তরাষ্ট্র আশা করে পাকিস্তান তাদের ভূখণ্ডে লুকিয়ে থাকা জঙ্গিদের খুঁজে বের করতে ভারতকে সহায়তা করবে। একইসঙ্গে, ভারতকেও সংযম প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে, যাতে পারমাণবিক শক্তিধর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যুদ্ধের দিকে না গড়ায়।
ভ্যান্স আরও বলেন, “আমরা চাই, ভারত এই সন্ত্রাসী হামলার প্রতিক্রিয়া এমনভাবে দেখাক, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের দিকে না নিয়ে যায়। একইসাথে, আমরা আশা করি, পাকিস্তানও তাদের ভূখণ্ডে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতা করবে।”
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও এর আগে বুধবার পাকিস্তানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন এবং দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা কমাতে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। পররাষ্ট্র দপ্তরের বিবৃতির মাধ্যমে জানা যায়, রুবিও কাশ্মীর হামলায় নিহতদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে আলাপে রুবিও গত ২২ এপ্রিলের সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন এবং তদন্তে পাকিস্তানের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা কামনা করেন। দুই নেতাই সন্ত্রাসীদের সহিংস কাজের জন্য তাদের জবাবদিহিতার বিষয়ে অবিচল থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ তারার এক বিবৃতিতে জানান, তাদের কাছে এমন ‘বিশ্বাসযোগ্য’ খবর আছে যে, ভারত আগামী ২৪ থেকে ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাতে পারে। যদিও পরবর্তীতে সেই সময়সীমা পার হয়ে গেছে।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পাহালগামে জঙ্গিরা ২৬ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করে, যাদের অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। এই ঘটনার জেরে তীব্র ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এরপর থেকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ চলছে।
উত্তেজনা ফলস্বরূপ, ভারত মঙ্গলবার পাকিস্তানের বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়। এর আগে, ইসলামাবাদও ভারতীয় বিমানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এছাড়াও, নয়াদিল্লি পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিল এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ জল চুক্তি স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বর্তমানে উভয় দেশই সামরিক শক্তি প্রদর্শন করছে। পাকিস্তানের নিরাপত্তা সূত্র থেকে জানা গেছে, মঙ্গলবার তারা বিতর্কিত কাশ্মীর অঞ্চলে ‘গোয়েন্দাগিরির’ জন্য ব্যবহৃত একটি ভারতীয় ড্রোন ভূপাতিত করেছে। এর দুদিন আগে, ভারত তাদের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার মাধ্যমে ‘লং রেঞ্জ প্রিসিশন স্ট্রাইকের জন্য প্ল্যাটফর্ম, সিস্টেম এবং ক্রুদের প্রস্তুতি’ প্রদর্শন করেছে।
জম্মু ও কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলওসি)-তে উত্তেজনা বিরাজ করছে এবং গত সাত দিন ধরে সেখানে গোলাগুলি বিনিময় হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
কাশ্মীর বিশ্বের অন্যতম বিপজ্জনক একটি অঞ্চল। এর কিছু অংশ ভারত এবং কিছু অংশ পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করে, তবে উভয় দেশই পুরো অঞ্চলটির উপর নিজেদের মালিকানা দাবি করে। এই বিতর্কিত অঞ্চল নিয়ে দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশ তিনটি যুদ্ধ করেছে।
২০১৯ সালে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে একটি বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বিমান হামলা চালায়। ১৯৭২ সালের যুদ্ধের পর এটি ছিল পাকিস্তানের ভূখণ্ডে প্রথম এই ধরনের অভিযান।
সাম্প্রতিক সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত একইভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর)-এর গবেষক স্টিভেন হানিগ এবং নাতালি ক্যালোকা’র মতে, ২০১৯ সালের তুলনায় এখন বৃহত্তর সংঘাতের সম্ভাবনা বেশি। সিএফআর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তারা লিখেছেন, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরের স্থিতিশীলতাকে তাঁর প্রধান লক্ষ্যের একটি করে তুলেছেন।
সামরিক সক্ষমতার তুলনা
উভয় দেশই বিপুল পরিমাণ সামরিক সরঞ্জামের অধিকারী। তবে প্রচলিত যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতের অবস্থান অনেক শক্তিশালী।
আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা ‘দ্য মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৫’ অনুসারে, ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট পাকিস্তানের তুলনায় নয় গুণেরও বেশি। ভারতের সক্রিয় সেনা সদস্য সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ, যেখানে পাকিস্তানের ৬ লাখ ৬০ হাজার।
স্থলভাগে ভারতের কাছে ৩ হাজার ৭৫০টি প্রধান যুদ্ধ ট্যাংক এবং ১০ হাজারের বেশি আর্টিলারি সরঞ্জাম রয়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানের ট্যাংকের সংখ্যা ভারতের দুই-তৃতীয়াংশ এবং আর্টিলারি সরঞ্জামের সংখ্যা অর্ধেকেরও কম।
নৌবাহিনীর দিক থেকেও ভারতের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। তাদের দুটি বিমানবাহী রণতরী, ১২টি গাইডেড-মিসাইল ডেস্ট্রয়ার, ১১টি গাইডেড-মিসাইল ফ্রিগেট এবং ১৬টি আক্রমণকারী সাবমেরিন রয়েছে। পাকিস্তানের কোনো বিমানবাহী রণতরী নেই। তাদের নৌবহরের মূল ভিত্তি ১১টি ছোট আকারের গাইডেড-মিসাইল ফ্রিগেট। সাবমেরিনের সংখ্যাও ভারতের তুলনায় অর্ধেক।
বিমানবাহিনীর ক্ষেত্রেও উভয় দেশ সোভিয়েত যুগের পুরনো বিমান ব্যবহার করে। ভারতের মিগ-২১ এবং পাকিস্তানের চীনা সমতুল্য জে-৭ উল্লেখযোগ্য।
তবে, উভয় দেশই আধুনিক চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছে। ভারত ফ্রান্সের তৈরি রাফাল যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করেছে, যার মধ্যে ৩৬টি বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে। পাকিস্তান তাদের বহরে চীনা জে-১০ মাল্টিরোল জেট যুক্ত করেছে, যার সংখ্যা ২০টির বেশি।
পাকিস্তানের কাছে এখনো অনেক মার্কিন এফ-১৬ যুদ্ধবিমান থাকলেও, তাদের প্রধান যুদ্ধবিমান হলো চীনের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করা জেএফ-১৭। বর্তমানে এই ধরনের প্রায় ১৫০টি বিমান সক্রিয় রয়েছে।
রাফাল বিমান সংগ্রহ করা সত্ত্বেও, রাশিয়ান যুদ্ধবিমান এখনো ভারতের বিমানবহরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভারতীয় বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীতে ১০০টির বেশি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান সক্রিয় রয়েছে। এছাড়াও, ২৬০টির বেশি সুখোই-৩০ গ্রাউন্ড অ্যাটাক জেট ভারতের বিমান শক্তি বৃদ্ধি করে।
পারমাণবিক অস্ত্রের দিক থেকে উভয় দেশই কাছাকাছি অবস্থানে রয়েছে। উভয় দেশের কাছে প্রায় ৫০টির বেশি সারফেস-টু-সারফেস ক্ষেপণাস্ত্র লঞ্চার রয়েছে। তবে ভারতের ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ভারতের দুটি পারমাণবিক সক্ষম সাবমেরিন রয়েছে, যেখানে পাকিস্তানের কোনো সাবমেরিন নেই।
তথ্যসূত্র: সিএনএন