গৃহপালিত প্রাণী, পোকামাকড় এবং খাদ্যশস্য – এদের মধ্যে মিল কোথায়? বিজ্ঞানীরা এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, কারণ ‘গৃহপালিত’ শব্দটির সংজ্ঞা এখনো পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি।
সম্প্রতি একদল বিজ্ঞানী একটি নতুন সংজ্ঞা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, যা হয়তো এই বিতর্কের অবসান ঘটাতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের একটি মেডিকেল স্কুলের গবেষক এলিনর কার্লসন এবং ক্যাথরিন লর্ড-এর নেতৃত্বে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, গৃহপালিত প্রাণী তারাই, যারা মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত একটি বিশেষ পরিবেশে বাঁচার জন্য বিবর্তিত হয়েছে এবং মানুষের সাহায্য ছাড়া তাদের পক্ষে সেই পরিবেশে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, কুকুর, ভুট্টা, নর্দমার ইঁদুর এবং বিছানার মাকড়সা-দের ‘গৃহপালিত’ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
অন্যদিকে, ঘোড়া বা মৌমাছির মতো প্রাণী, যারা মানুষের দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশে সুবিধা ভোগ করে, কিন্তু মানুষের সাহায্য ছাড়া বাঁচতে পারে, তাদের এই তালিকায় ফেলা হয়নি।
বিজ্ঞানীরা এদের ‘মানুষের সুবিধাভোগী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এই নতুন সংজ্ঞা দেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘গৃহপালিত’ শব্দটির সঠিক সংজ্ঞা না থাকায় বিজ্ঞানীরা বিষয়টি নিয়ে সুসংহতভাবে গবেষণা করতে পারছিলেন না।
উদাহরণস্বরূপ, একটি বিড়ালকে যদি বাড়ির বাইরেও অবাধে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়, তবে তাকে কি পুরোপুরি গৃহপালিত বলা যাবে?
অথবা, একটি গরুকে খামারে পালন করা হলেও, সে তো বন্য পরিবেশে বাঁচতে পারে।
তবে, এই নতুন সংজ্ঞার সঙ্গে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নগর বাস্তুবিদ ক্রিস শেল মনে করেন, ‘গৃহপালন’ বিষয়টি মানুষের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
মানুষ যে প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্যগুলো নিজেদের জন্য পছন্দ করে, সেগুলোরই তারা প্রজনন ঘটায়।
অন্যদিকে, হুড কলেজের জীববিজ্ঞানী কার্লোস ড্রিসকলের মতে, গৃহপালিত প্রাণী হলো তারাই, যাদের মধ্যে মানুষের প্রভাবে জিনগত পরিবর্তন ঘটেছে।
আবার, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্ন-উদ্ভিদবিদ অ্যামি বোগার্ডের মতে, ‘গৃহপালন’ একটি আন্তঃ-প্রজাতি সম্পর্ক।
মানুষ এবং প্রাণীর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমেই এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয়।
নতুন সংজ্ঞায় ফিরে আসা যাক।
লর্ড এবং কার্লসন-এর মতে, একটি প্রাণী ‘গৃহপালিত’ কিনা, তা নির্ভর করে মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং মানুষের তৈরি করা পরিবেশে তার টিকে থাকার ক্ষমতার উপর।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ল্যাকটোব্যাসিলাস ল্যাকটিস নামক একটি ব্যাকটেরিয়া, যা পনির তৈরিতে সাহায্য করে।
এটি মানুষের তৈরি করা পরিবেশে এতটাই অভ্যস্ত যে, পনির তৈরির প্রক্রিয়া ছাড়া এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব নয়।
একইভাবে, ইঁদুর বা বিছানার মাকড়সার মতো প্রাণীরা মানুষের আশেপাশে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে।
তবে, কিছু বিজ্ঞানী এই সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
তাদের মতে, এই সংজ্ঞাটি বিদ্যমান ‘অবলিগেট সিনানথ্রোপ’ (obligate synanthrope) নামক একটি ধারণার অনুরূপ।
এটি এমন একটি অবস্থা, যেখানে একটি প্রাণী মানুষের পরিবেশের উপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই নতুন সংজ্ঞা বিতর্কের অবসান ঘটাতে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যতে গৃহপালন বিষয়ক গবেষণায় এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
তবে, এই সংজ্ঞা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে।
প্রকৃতির পরিবর্তনশীলতা এবং মানুষের দ্বারা পরিবেশের উপর ক্রমাগত প্রভাবের কারণে, গৃহপালিত প্রাণীর ধারণা ভবিষ্যতে আরও জটিল হয়ে উঠবে, এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক