শিরোনাম: ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিশেল: নরওয়ের লোকসংগীতে নতুন জোয়ার, নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনারেশন-জেড
উত্তুরে দেশ নরওয়ে, যেখানে পাহাড় আর সমুদ্রের মেলবন্ধন, সেখানকার লোকসংগীত যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের মূল কারিগর সেখানকার তরুণ প্রজন্ম, জেনারেশন-জেড। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এক দারুণ উদাহরণ তৈরি হয়েছে সেখানে।
সম্প্রতি, নরওয়ের শহরগুলোতে লোকসংগীতের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, বিশেষ করে ক্লাব নাইটগুলোতে তরুণ প্রজন্মের ভিড় চোখে পড়ার মতো। রাজধানী অসলো’র ‘রিকসসেন’ (Riksscenen), যা জাতীয় লোকসংগীত ও নৃত্য কেন্দ্র, সেখানে ‘টুভাস ব্লাডক্লাব’ (Tuvas Blodklubb) নামে একটি মাসিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে প্রতি মাসে শত শত মানুষের সমাগম হয়।
শুধু অসলোতেই নয়, বার্গেন, ট্রনহাইম এবং ট্রোমসো সহ আরও অনেক শহরেও এই ধরনের ক্লাব তৈরি হয়েছে।
অনুষ্ঠানটির উদ্যোক্তা হলেন তুভা সিভার্টসেন, যিনি পেশায় একজন সঙ্গীতশিল্পী। সাত বছর আগে তিনি এই ক্লাবটি শুরু করেন। তুভা বলেন, “আমি চেয়েছিলাম এমন একটা জায়গা তৈরি করতে যেখানে মানুষজন লোকসংগীতের সাথে নাচতে পারবে এবং ভালো সময় কাটাতে পারবে।
তার মতে, এই প্রজন্মের কাছে লোকসংগীতের আবেদন তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ হল অস্থির এই বিশ্বে শিকড়ের প্রতি তাদের আকর্ষণ। তরুণরা এমন কিছু চায় যা তাদের পরিচিত, উষ্ণ এবং কাছের।
নরওয়ের লোকসংগীতের ইতিহাস কয়েকশ বছরের পুরনো। হার্ডিংফেল (এক ধরনের নরওয়েজিয়ান বেহালা), বকহর্ন (ছাগলের শিং দিয়ে তৈরি বাদ্যযন্ত্র) এবং ল্যাঙ্গলেইক (এক ধরনের তারের বাদ্যযন্ত্র) –এর মতো ঐতিহ্যবাহী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে এই সংগীত পরিবেশিত হয়।
শুধু বাদ্যযন্ত্রই নয়, এই প্রজন্মের হাত ধরে যেন পুরোনো অনেক কিছুই নতুন করে জেগে উঠছে। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘জোইকিং’ নামক একটি ঐতিহ্যবাহী গানের ধারা। এটি মূলত ‘সামী’ সম্প্রদায়ের মানুষের গান।
একসময় নরওয়েজিয়ান সরকার এই গানকে স্কুলে নিষিদ্ধ করেছিল, তবে বর্তমানে মারজা মর্টেনসন-এর মতো তরুণ শিল্পীদের হাত ধরে এটি আবার জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
মারজা মর্টেনসন মনে করেন, লোকসংগীতকে টিকিয়ে রাখতে হলে, তরুণ প্রজন্মের কাছে এর উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন, “ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে, জনপ্রিয় সঙ্গীতেও জোইকিং-এর ব্যবহার জরুরি।
টুভাস ব্লাডক্লাবের রাতের অনুষ্ঠানে নাচের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনুষ্ঠানের আগে, তুভা সবার জন্য নাচের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেন। তিনি জানান, এখানে আসা অনেক তরুণ-তরুণী লাইভ মিউজিকের সাথে নাচতে অভ্যস্ত নয়, তবে লোকসংগীতে শিল্পী এবং নর্তকদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
অনুষ্ঠানে লাইভ পারফর্মেন্সের পাশাপাশি, ডিজে সিসিফাসের (DJ Sissyfus) মতো ডিজে-রা পুরনো লোকসংগীতের রিমিক্স করেন। কখনো কখনো তারা হার্ডিংফেলের সুরে গানও করেন।
তুভা বলেন, “আমরা স্টেজের নিচে মাইক্রোফোন লাগাই, যাতে শুধু কণ্ঠ এবং পায়ের শব্দ শোনা যায়। এটা সত্যিই অসাধারণ।
এছাড়াও, এখানে লোকসংগীতের কারাওকে সেশনও অনুষ্ঠিত হয়।
ভবিষ্যতে, তুভা সিভার্টসেন এই ক্লাবটিকে লন্ডন বা বার্লিনের মতো অন্যান্য শহরে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তার মতে, “এই ক্লাব নাইটটি নরওয়েজিয়ানদের জন্য খুবই আকর্ষণীয়, তাই আমার মনে হয় অন্য কোথাও এটি একইভাবে কাজ করবে।
হার্ডিংফেল বাজানো তুভার মতে, একটি বাদ্যযন্ত্রের ক্ষমতা এবং শত শত বছর ধরে এর টিকে থাকার গল্প লোকসংগীতের প্রতি তার আকর্ষণ তৈরি করেছে। তিনি বলেন, “ঐ সুর এবং গল্পগুলোর মধ্যে এমন কিছু আছে যা আজও প্রাসঙ্গিক।
ঐতিহ্যকে ধরে রাখা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দেওয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার এই প্রয়াস, আমাদের দেশের লোকসংগীতের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান