শিরোনাম: জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু: মিথ্যা তথ্যের বিস্তার আর বর্ণবাদের ছায়া
২০২০ সালের ২৫শে মে, যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের হাতে নিহত হন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড। ফ্লয়েডের মৃত্যুর পাঁচ বছর পরেও তাঁর মৃত্যু নিয়ে ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, যা বর্ণবাদের গভীর ক্ষতকে আরও একবার সামনে নিয়ে এসেছে।
ডেরেক চৌভিন নামের ওই পুলিশ অফিসার ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু গেড়ে প্রায় নয় মিনিট চেপে ধরে ছিলেন, যার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার একটি ভিডিও বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে, যা পুলিশি বর্বরতা এবং বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ সৃষ্টি করে।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাদক ব্যবহারের যে ভিত্তিহীন তত্ত্ব ছড়ানো হচ্ছে, তা মূলত বর্ণবাদী মানসিকতা থেকে উৎসারিত। এই মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে ফ্লয়েডের চরিত্র হনন করার চেষ্টা করা হচ্ছে এবং তাঁর মৃত্যুর জন্য পুলিশকে দায়ী করা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।
এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও ডেরেক চৌভিনকে ক্ষমা করার দাবি তুলেছেন, যেন ফ্লয়েডের মৃত্যুর দায় থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া যায়।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর পরে, ২০২০ সালে ডেরেক চৌভিনকে দ্বিতীয়-ডিগ্রি অনিচ্ছাকৃত হত্যা ও দ্বিতীয়-ডিগ্রি নরহত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরবর্তীতে, আদালত ফ্লয়েডের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের দায়ে চৌভিনকে আরও একবার দোষী সাব্যস্ত করে।
বর্তমানে, চৌভিন কারাবন্দী আছেন এবং তাঁর সাজা বিশ বছরের বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগও তদন্ত করে দেখেছে যে, ফ্লয়েডের মৃত্যুর পেছনে মিনিয়াপলিস শহরের পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল। তাদের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ও আদিবাসী আমেরিকানদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণের অভিযোগ আনা হয়েছে।
কিন্তু ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর থেকেই, তাঁর মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাদক ব্যবহারের একটি ভুল ধারণা তৈরি করা হয়। এই মিথ্যা তথ্য প্রচারের পেছনে মূল কারণ ছিল, যারা বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের বিরোধীতা করে, তারা ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল।
তারা ফ্লয়েডের অতীত জীবন এবং তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে থাকে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পদ্ধতিগত বর্ণবাদ এই ধরনের ভুল তথ্যের বিস্তারে সহায়তা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক র্যাচেল কুও, যিনি জাতি, সামাজিক আন্দোলন এবং প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা করেন, এই বিষয়ে বলেন, “ব্ল্যাক সম্প্রদায়ের মানুষের অপরাধ প্রবণতা এবং তাদের ‘নিরীহ শিকার’ হিসেবে গণ্য না করার মতো দীর্ঘদিনের বর্ণবাদী ধারণাগুলোই এই মিথ্যা তথ্যের মূল ভিত্তি।”
২০২০ সালের গ্রীষ্মে ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে সংগঠিত বিক্ষোভগুলি ২০১৪ এবং ২০১৬ সালের পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে হওয়া বিক্ষোভের ধারাবাহিকতা ছিল। ফ্লয়েডের ঘটনা এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে, যা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
তবে, এই আন্দোলনের দৃশ্যমানতা বাড়ার সাথে সাথে এর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর প্রবণতাও বাড়ে। কুও বলেন, যখন কোনো সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হয়, তখন তাদের দাবির বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়।
এক্ষেত্রে, ফ্লয়েডের ঘটনার ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলনকে দুর্বল করার চেষ্টা করা হয়।
ফ্লয়েডের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাদক ব্যবহারের যে তত্ত্ব প্রচার করা হয়, তার পেছনে আরও একটি কারণ হলো ঘটনার ভুল বিশ্লেষণ। পুলিশ জানায়, ফ্লয়েড একটি ২০ ডলারের জাল নোট ব্যবহার করেছিলেন, যে কারণে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
তাঁর অতীতের মাদক সংশ্লিষ্ট অভিযোগগুলো সামনে এনে তাঁর সম্পর্কে মিথ্যা ধারণা তৈরি করা হয়।
যদিও ময়নাতদন্তে ফ্লয়েডের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, তবুও মাদক ব্যবহারের তত্ত্বটি প্রচার করা হচ্ছে। এমনকি, কিছু সংবাদমাধ্যম এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এই মিথ্যা তথ্যকে সমর্থন করছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে, দ্রুত কোনো খবর ছড়িয়ে পরে, এবং সহজেই ভুল তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডিন ফ্রিলন, যিনি ডিজিটাল রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেন, বলেন, “মিথ্যা তথ্য মূলত সেই সব গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ছড়ানো হয়, যারা আগে থেকেই প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে।”
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু এবং এর পরবর্তী ঘটনাগুলো একটি বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করেছে, যা অনলাইনে দ্রুত ছড়িয়ে পরে এবং দীর্ঘকাল ধরে আলোচনায় রয়েছে।
তাই, এই ধরনের ভুল তথ্য থেকে সচেতন থাকাটা খুব জরুরি।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা