বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর নির্দেশিকা অনুযায়ী, বিশ্বের মাত্র সাতটি দেশের বাতাস মানুষের শ্বাস নেওয়ার জন্য নিরাপদ। সম্প্রতি, সুইস বায়ু গুণমান প্রযুক্তি বিষয়ক প্রতিষ্ঠান IQAir-এর এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। বায়ু দূষণের দিক থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক, যেখানে PM2.5 কণার মাত্রা WHO-এর নির্ধারিত মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং এস্তোনিয়ার মতো কয়েকটি দেশ, গ্রিনল্যান্ড ও কিছু দ্বীপরাষ্ট্রসহ, PM2.5-এর বার্ষিক গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের নিচে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে, সবচেয়ে দূষিত দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে চাদ, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং ভারত। এই দেশগুলোতে PM2.5-এর মাত্রা WHO-এর নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বেশি, এমনকি চাদে তা ১৮ গুণ পর্যন্ত বেশি।
চিকিৎসকদের মতে, PM2.5-এর কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। এই অতি ক্ষুদ্র কণাগুলো রক্তপ্রবাহে মিশে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের ক্ষতি করতে পারে। তাঁরা সতর্ক করে বলেছেন, WHO-এর নির্দেশিকা অনুসরণ করা গেলে প্রতি বছর লাখো মানুষের জীবন বাঁচানো সম্ভব। উচ্চ রক্তচাপের পরেই দূষিত বাতাস মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ। IQAir-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রাঙ্ক হামেস বলেন, “বায়ু দূষণ তাৎক্ষণিকভাবে মানুষকে মেরে ফেলে না, তবে স্বাস্থ্যগত প্রভাব দেখা যেতে দুই থেকে তিন দশক পর্যন্ত সময় লাগতে পারে, যদি না দূষণের মাত্রা খুবই বেশি হয়। আর এই দূষণ প্রতিরোধের বিষয়টি মানুষজন জীবনের শেষ দিকে এসে উপলব্ধি করে।”
গবেষণায় কিছু ইতিবাচক দিকও উঠে এসেছে। যেমন, দূষণ নিয়ন্ত্রণে আনা শহরগুলোর সংখ্যা ২০২৩ সালের ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৪ সালে ১৭ শতাংশ হয়েছে। ভারতের বায়ু দূষণও কিছুটা কমেছে, যা দেশটির জন্য একটি স্বস্তিদায়ক খবর। এছাড়া, চীনের বায়ু গুণমানেও উন্নতি হয়েছে, বিশেষ করে ২০১৩ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে PM2.5 দূষণ প্রায় অর্ধেক কমে এসেছে। বেইজিংয়ের বায়ু এখন বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার রাজধানী সারায়েভোর কাছাকাছি, যা ইউরোপের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম।
কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত রোগতত্ত্ববিদ জোরানা জোভানোভিক অ্যান্ডারসন, যিনি এই গবেষণার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না, তিনি বলেন, “ইউরোপের মতো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মহাদেশেও বায়ু দূষণের বিশাল পার্থক্য দেখা যায়। পূর্বাঞ্চলীয় ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাইরের বালকান অঞ্চলের নাগরিকেরা সবচেয়ে দূষিত বাতাস গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সবচেয়ে কম এবং বেশি দূষিত শহরের মধ্যে PM2.5-এর মাত্রায় ২০ গুণ পর্যন্ত পার্থক্য রয়েছে।”
গবেষণায় পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, সরকারগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ করতে পারে, গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে পারে, হাঁটা ও সাইকেল চালানোর মতো পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো তৈরি করতে পারে এবং কৃষিজমি ও ফসলের বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে পারে। গবেষণাটি তৈরি করতে গবেষকরা সারা বছর ধরে মাঠপর্যায়ে বায়ু দূষণের রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহ করেছেন। এই ডেটা সংগ্রহের এক-তৃতীয়াংশ ছিল সরকারি সংস্থাগুলোর, বাকিগুলো সংগ্রহ করেছে বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থা, স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত সেন্সর।
আফ্রিকা ও পশ্চিম এশিয়ার কিছু অংশে বায়ু গুণমান পর্যবেক্ষণের দুর্বলতা রয়েছে। অনেক দরিদ্র দেশে দূষণের মাত্রা বেশি হলেও, সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাপ কেন্দ্র না থাকায় নাগরিকদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছানো যায় না, ফলে নীতিনির্ধারণেও সমস্যা হয়। ইউট্রেখ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশগত রোগতত্ত্ববিদ রয়্যাল ভারমুলেনের মতে, ডেটা-সংক্রান্ত দুর্বলতা রয়েছে এমন অঞ্চলগুলোতে, বিশেষ করে যেখানে নিয়ন্ত্রিত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র কম, সেখানে এই ধরনের গবেষণায় কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। তবে ইউরোপের তথ্য আগের গবেষণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। তিনি আরও বলেন, ” কার্যত, বিশ্বের সবাই খারাপ বাতাস গ্রহণ করছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, এই দূষণের মাত্রা এক এক স্থানে এক এক রকম।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বায়ু দূষণের এই চিত্র অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানার নির্গমন, এবং ফসলের মৌসুমে খড় পোড়ানোর কারণে বায়ু দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করে। এর ফলে শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়ছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি। এখনই বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে, এর কুফল আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর আরও ভয়াবহভাবে পড়বে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান