যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি প্রস্তুতকারকদের দ্বিধা: শুল্কের ভয়ে কি উৎপাদন সরিয়ে নিচ্ছে না তারা?
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য ছিল, শুল্ক এড়াতে গাড়ি প্রস্তুতকারকরা যেন তাদের উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রের কারখানায় সরিয়ে নেয়। কিন্তু বাস্তবতা এত সহজ নয়। ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক এরই মধ্যে কার্যকর হয়েছে, এবং খুব সম্ভবত আগামী মাস থেকে এশিয়া ও ইউরোপ থেকে আসা গাড়ির ওপরও শুল্ক আরোপ করা হবে। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, কানাডা ও মেক্সিকো থেকে আমদানি করা গাড়িসহ সব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যা ট্রাম্পের শাসনামলে দুবার স্থগিত করা হলেও, এপ্রিল মাস থেকে তা পুনরায় কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসন যদিও গাড়ি প্রস্তুতকারকদের শুল্ক থেকে বাঁচানোর জন্য উৎপাদন আমেরিকায় সরিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি বেশ জটিল।
খরচ এবং বিশৃঙ্খলা
ফোর্ড সিইও জিম ফার্লির মতে, ট্রাম্পের শুল্কের হুমকি প্রস্তুতকারকদের জন্য “অনেক খরচ এবং অনেক বিশৃঙ্খলা” সৃষ্টি করছে। তারপরও তারা নতুন কারখানা তৈরি করতে চাইছে না, অন্তত এখনই নয়।
এর কারণ হলো, শুল্কের ওপর ট্রাম্পের নীতিমালায় স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে, যা নতুন কারখানায় কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগের জন্য প্রস্তুতকারকদের প্রয়োজনীয় নিশ্চয়তা দেয় না। জেনারেল মোটরসের প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা (সিএফও) পল জ্যাকবসন গত মাসে বিনিয়োগকারীদের বলেন, “ভবিষ্যতের বাণিজ্য নীতির বিষয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন রয়েছে, যার উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। বাজারে শুল্কের প্রভাব এবং মুনাফা হ্রাসের বিষয়টি বিবেচনা করা হলেও, আমরা যদি কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করি এবং পরে যদি দেখি নীতি পরিবর্তন হয়ে গেছে, তবে ব্যবসায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে।”
শুল্কের কারণে ক্ষতির পরিমাণও অনেক। যদিও ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপরের শুল্ক সরাসরি গাড়ি প্রস্তুতকারকদের খরচ বাড়াবে না, কারণ তাদের সরবরাহকারীদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি রয়েছে। তবে আমেরিকান উৎপাদকদের কাছ থেকে কিনলেও তাদের দাম বাড়াতে হতে পারে।
২০১৮ সালে কানাডার ইস্পাত ও অ্যালুমিনিয়ামের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে জেনারেল মোটরস এবং ফোর্ডের প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, গত দুই মাসে আমেরিকান ইস্পাতের দাম ৩০ শতাংশের বেশি এবং অ্যালুমিনিয়ামের দাম ১৫ শতাংশ বেড়েছে।
নতুন কারখানা তৈরি সহজ নয়
একটি কারখানায় অন্য মডেলের গাড়ি তৈরি শুরু করতে এক বছর বা তার বেশি সময় লাগতে পারে। এমনকি একটি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা পুনরায় চালু করতেও কয়েক বছর লেগে যায়।
উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের ইউনাইটেড অটো ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ধর্মঘট অবসানের শর্ত হিসেবে, জিপ, রাম, ডজ এবং ক্রাইসলার ব্র্যান্ডের গাড়ি তৈরি করা স্টিলান্টিস ইলিনয়ের বেলভিডিয়ারের একটি কারখানা পুনরায় চালু করতে রাজি হয়েছিল। তারা জানায়, ২০২৭ সালের আগে এই কারখানায় উৎপাদন শুরু করা সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি শিল্পের “রক্ষা” করার জন্য শুল্কের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও, বর্তমানেও দেশটির কারখানাগুলো উত্তর আমেরিকার বাজারের সিংহভাগ গাড়ির উৎপাদন করে। এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল মোবিলিটির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোতে ১ কোটি ২ লক্ষ গাড়ি তৈরি হয়েছে, যেখানে মেক্সিকোতে তৈরি হয়েছে ৪০ লক্ষ এবং কানাডায় ১৩ লক্ষ।
যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত গাড়ির প্রায় অর্ধেকই তৈরি হয় এশীয় বা ইউরোপীয় ব্র্যান্ডের “ট্রান্সপ্লান্ট” কারখানায়, যেমন টয়োটা, হোন্ডা, বিএমডব্লিউ এবং ভক্সওয়াগেন। এর কারণ শুল্ক নয়, বরং সমুদ্রপথে গাড়ি পরিবহনের খরচ অনেক বেশি হওয়ায়, বাজারের কাছাকাছি উৎপাদন করা লাভজনক।
মেক্সিকোতে তৈরি কিছু মডেল, যেমন জিপ কম্পাস বা ফোর্ড ব্রঙ্কো স্পোর্ট, তুলনামূলকভাবে কম লাভজনক। এই ধরনের গাড়ি যদি যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি করা হয়, তবে শ্রমিকের বেতন বাড়াতে হবে। অথবা, মেক্সিকোতে তৈরি করে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করলে গাড়ির দাম অনেক বেড়ে যাবে, যা ক্রেতাদের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। ফলে প্রস্তুতকারকরা হয়তো এই মডেলগুলো উৎপাদন বন্ধ করে দিতে পারে। এমনটা হলে একদিকে যেমন সাশ্রয়ী মূল্যের গাড়ির সংকট তৈরি হবে, তেমনি আমেরিকান কর্মীদের চাকরি হারানোর ঝুঁকিও বাড়বে, কারণ মেক্সিকোতে তৈরি হওয়া গাড়িতেও আমেরিকান যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হয়।
“সব আমেরিকান” গাড়ি বলে কিছু নেই
গাড়ি প্রস্তুতকারকরা নতুন কারখানা তৈরি করলেও বা বিদ্যমান কারখানায় উৎপাদন বাড়ালেও, শুল্কের কারণে “আমেরিকান” গাড়ির দাম ৩ হাজার থেকে ১২ হাজার ডলার পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মিশিগানভিত্তিক গবেষণা সংস্থা অ্যান্ডারসন ইকোনমিক গ্রুপের মতে, এই বাড়তি খরচ ডিলারদের ওপর চাপানো হবে, যা পরবর্তীতে ক্রেতাদের ওপর বর্তাবে। ফলে গাড়ির দাম আরও বেড়ে যাওয়ায় অনেকের পক্ষেই তা কেনা কঠিন হয়ে পড়বে।
ঐতিহ্যগতভাবে, নর্থ আমেরিকা একটি একক বাজার হিসেবে কাজ করে আসছে, প্রথমে ন্যাটফা এবং পরে ইউএসএমসিএর অধীনে। এই চুক্তির ফলে প্রস্তুতকারকরা সীমান্ত পেরিয়ে যন্ত্রাংশ আনা-নেওয়া করতে পারত। মেক্সিকো যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় ৮২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের যন্ত্রাংশ রপ্তানি করে, যার বেশিরভাগই গাড়ি প্রস্তুতকারকদের কারখানায় ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, কানাডা থেকে আসে ১৯ বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারকরা মেক্সিকো ও কানাডায় যথাক্রমে ৩৬ বিলিয়ন এবং ২৮ বিলিয়ন ডলারের যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। সীমান্ত জুড়ে যন্ত্রাংশের এই চলাচল শুল্কের কারণে বন্ধ হয়ে গেলে, কয়েক লক্ষ আমেরিকান কর্মীর চাকরি হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
গাড়ির যন্ত্রাংশ সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কারণে, “সব আমেরিকান” গাড়ি বলে কিছু নেই। এমনকি ইউএসএমসিএ চুক্তির অধীনে, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি যন্ত্রাংশকে একই দেশীয় উপাদান হিসেবে গণ্য করা হয়।
শুল্কের কারণে নতুন কারখানার পরিকল্পনা নেই
ট্রাম্প দাবি করেন, গাড়ি প্রস্তুতকারকরা এরই মধ্যে নতুন কারখানা তৈরির পরিকল্পনা করছে। তিনি সম্প্রতি কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে বলেন, “আমরা অটো শিল্পে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি দেখতে যাচ্ছি, কারণ সারা দেশে নতুন নতুন কারখানা তৈরি হচ্ছে।”
হোন্ডা এরই মধ্যে ইন্ডিয়ানা রাজ্যে একটি নতুন কারখানা তৈরির ঘোষণা দিয়েছে, যা সম্ভবত বিশ্বের বৃহত্তম কারখানাগুলোর মধ্যে একটি হবে। তবে এই মুহূর্তে যে কারখানাগুলো নির্মাণাধীন, তার কিছু অর্থের যোগান এসেছে, প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের “ইনফ্লেশন রিডাকশন অ্যাক্ট” থেকে, যা ট্রাম্প বাতিল করতে চান।
তবে হোন্ডা ২০০৮ সাল থেকে ইন্ডিয়ানাতে একটি কারখানা পরিচালনা করে আসছে। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হোন্ডা মেক্সিকোতে পরবর্তী প্রজন্মের হোন্ডা সিভিক তৈরি করার পরিকল্পনা বাতিল করেছে এবং এটি ইন্ডিয়ানার বিদ্যমান কারখানাতেই তৈরি করবে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মেক্সিকান পণ্য রপ্তানির ওপর শুল্কের হুমকির কারণেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
ফোর্ডের সিইও ফার্লি বিনিয়োগকারীদের বলেন, “সত্যি বলতে, মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হলে, তা যুক্তরাষ্ট্রের গাড়ি শিল্পকে একেবারে ধ্বংস করে দেবে।”
তথ্যসূত্র: সিএনএন