মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কিছু বাণিজ্য শুল্ক আরোপের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে রায় দেওয়ায় তাঁর পুরো অর্থনৈতিক পরিকল্পনাতেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। বুধবারের এই রায়ের ফলে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য নীতি এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংস্কারের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
আদালতের এই রায়ে ট্রাম্পের মূল অর্থনৈতিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ দুর্বল হয়ে গেল। ট্রাম্পের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা মূলত তিনটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে ছিল: শুল্ক বৃদ্ধি, সরকারি ব্যয় হ্রাস এবং কর হ্রাস। এখন শুল্ক বিষয়ক নীতিতে চ্যালেঞ্জ আসায়, এই তিনটির সমন্বয়ে গঠিত পুরো কাঠামোটি নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।
আদালত ‘লিবারেশন ডে’ শুল্ক, ১০ শতাংশ হারে সার্বজনীন শুল্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রে ফেনটাইল প্রবেশ রোধে আরোপিত শুল্কসহ ট্রাম্পের বিভিন্ন বাণিজ্য শুল্কের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আদালত জানিয়েছে, জরুরি অবস্থার কথা উল্লেখ করে শুল্ক আরোপের যে ক্ষমতা ট্রাম্প ব্যবহার করেছেন, তা সঠিক নয়।
এই রায়ের ফলে, ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য চুক্তিগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। এর আগে, এই শুল্কের কারণে অনেক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করতে রাজি হয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, এই চুক্তিগুলো বাস্তবায়িত হলে বিদেশি বাজারগুলোতে মার্কিন পণ্যের প্রবেশ সহজ হবে, যা মার্কিন প্রস্তুতকারক ও কৃষকদের জন্য লাভজনক হতো।
অন্যদিকে, শুল্ক থেকে অর্জিত রাজস্ব ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের বিশাল কর হ্রাসের পরিকল্পনাকে সহায়তা করত। এই কর হ্রাসের ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং ঋণ গ্রহণের সীমা বাড়ানোর মাধ্যমে বাজারের স্থিতিশীলতাও আসতে পারত। এছাড়াও, সরকারি দপ্তরগুলোর কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং সরকারের ব্যয় হ্রাসের মাধ্যমেও এই কর হ্রাসের প্রভাব কিছুটা কমানো যেত।
কিন্তু এখন ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা প্রশ্নের মুখে। কারণ, তাঁর অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি দুর্বল। অর্থনীতিবিদ এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন ও প্রশাসনিক সক্ষমতা ট্রাম্প প্রশাসনের নেই। এলন মাস্কের মতো ট্রাম্পের প্রভাবশালী সমর্থকরাও এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। মাস্ক মনে করেন, এই বিল আমেরিকার ঋণের বোঝা বাড়াবে, যা সরকারের ব্যয় সংকোচনের প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করবে।
শেয়ার বাজারের বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুল্ক থেকে রাজস্ব প্রাপ্তি কমে গেলে, রিপাবলিকানদের মধ্যে যারা আর্থিক বিষয়ে রক্ষণশীল, তারা ট্রাম্পের কর হ্রাসের প্রস্তাব সমর্থন নাও করতে পারেন। কারণ, এই বিলের প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলারের (প্রায় ৪৪০ লক্ষ কোটি টাকা) বিশাল ব্যয়ের বিষয়টি তাদের উদ্বেগের কারণ।
অর্থনীতিবিদদের মতে, শুল্ক থেকে বছরে প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ১৬.৫ লক্ষ কোটি টাকা) রাজস্ব পাওয়া যেত, যা ঘাটতি কমাতে সাহায্য করত। এখন আদালতের রায়ের কারণে, ট্রাম্প ও রিপাবলিকানদের হয় কর হ্রাসের পরিমাণ কমাতে হবে, না হয় সরকারি ব্যয় আরও কমাতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে অনেক প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, কিন্তু উত্তর এখনো অজানা। ট্রাম্প প্রশাসন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে, যা সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত যেতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, এই আপিলের ফলে বাণিজ্য চুক্তিগুলো বিলম্বিত হতে পারে। এছাড়াও, এই রায়ের কারণে ব্যবসায়ীরাও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছেন। কারণ, শুল্ক সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করা হলে, ব্যবসায়ীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়বে।
তবে, পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি পাল্টায়নি। প্রশাসন চাইলে বাণিজ্য সম্প্রসারণ আইনের ২৩২ ধারা ব্যবহার করে শুল্ক আরোপ করতে পারে, যা আদালতের রায়ের আওতাভুক্ত নয়। এই ধারার অধীনে, ট্রাম্প ইতিমধ্যে ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, গাড়ি এবং গাড়ির যন্ত্রাংশের উপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন।
মোটকথা, এই মুহূর্তে ট্রাম্প প্রশাসনের অর্থনৈতিক এজেন্ডা বেশ কঠিন সময় পার করছে। আদালতের এই রায় বাণিজ্য নীতিতে পরিবর্তন আনবে, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন