কর্নোয়ালের সমুদ্র সৈকতে জীবনের নতুন দিগন্ত: শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন।
ছোটবেলা থেকেই শারিরীক নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিলেন শার্লট ব্যানফিল্ড। সেরিব্রাল পালসি, মৃগীরোগ এবং অটিজম-এর মতো সমস্যাগুলো তাকে সবসময় একাকী করে রাখতো।
স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হয়ে হতাশায় আত্মহত্যার কথা পর্যন্ত ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু মায়ের উৎসাহে ১৩ বছর বয়সে ‘ওয়েভ প্রজেক্ট’-এর একটি সার্ফিং কোর্সে ভর্তি হওয়ার পরই তার জীবনে আসে পরিবর্তন।
ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে কিভাবে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া যায়, সেই শিক্ষাই যেন বদলে দেয় তার জীবন।
প্রথম দিকে অবশ্য জলকে ভয় পেতেন শার্লট। পানিতে নামতেই চাইতেন না। কিন্তু ধীরে ধীরে সমুদ্রের সঙ্গে তার এক অন্যরকম সম্পর্ক তৈরি হয়।
ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে যেন মুক্তি খুঁজে পান তিনি। স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার উপক্রম হলেও, সার্ফিং তাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছিল।
পরবর্তীতে মেরিন বায়োলজিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। শার্লট বলেন, “সার্ফিং আমাকে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছে।”
আজ সেই শার্লট একজন সফল সার্ফার। শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে তিনি বিশ্ব প্যারা সার্ফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
তার এই সাফল্যের গল্প এখন কর্নওয়ালের ন্যাশনাল মেরিটাইম মিউজিয়ামে ‘সার্ফ! ১০০ ইয়ার্স অফ ওয়েভারাইডিং ইন কর্নওয়াল’ শীর্ষক এক প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে।
কর্নোয়ালের প্রায় ৬৮০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত সমুদ্র উপকূল সার্ফিংয়ের জন্য আদর্শ।
এখানকার নরম বালুকাময় সৈকতগুলো অন্যরকম এক অনুভূতি দেয়। আটলান্টিক মহাসাগরের ঢেউগুলো বছরের প্রায় সবসময়ই এখানে আসে, যা সার্ফারদের জন্য দারুণ সুযোগ তৈরি করে।
এই অঞ্চলের আবহাওয়ারও রয়েছে বিশেষত্ব। এখানকার আলো সবসময় আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রতিফলিত হয়ে আসে, যা কর্নওয়ালকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
এখানে সমুদ্রের গর্জন বা ‘মর্ডোস’-এর শব্দ সবসময় শোনা যায়। এছাড়া, এখানকার প্রাক্তন পেশাদার সার্ফার রবিন ডেভিসের মতে, সমুদ্রের ৪০০০ মাইল পাড়ি দিয়ে আসা ঢেউগুলোতে চড়া এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
ঐতিহাসিক ভাবে, কর্নওয়ালের সার্ফিং সংস্কৃতি বাইরের বিভিন্ন সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
একসময়, এখানকার টিন-খনির শ্রমিকেরা তাহিতি, হাওয়াই এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমুদ্র সৈকতে সার্ফিং করতে যেতেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, মার্কিন সেনারাও এখানে তাদের সার্ফিং কৌশল প্রদর্শন করতেন, যা স্থানীয়দের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।
ষাটের দশকে চারজন অস্ট্রেলীয় সার্ফার- বব হেড, ইয়ান টাইলি, জন ক্যাম্পবেল এবং ওয়ারেন মিচেল এখানকার সার্ফিংয়ে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন।
তাদের ‘হটডগ সার্ফিং’ কৌশল নিউকয়ের স্থানীয়দের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। এরপর ‘বীচ বয়েজ’ এবং ‘জান অ্যান্ড ডিন’-এর গান বাজিয়ে এখানে সার্ফিং একটি সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়।
সময়ের সাথে সাথে এখানে দক্ষ সার্ফবোর্ড কারিগরদেরও আবির্ভাব হয়।
তবে, সার্ফিং সব সময় সহজ ছিল না।
একসময় বডি-বোর্ডার এবং লং-বোর্ডারদের মধ্যে মারামারি হওয়ায় নিউকয়েতে সার্ফিং নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। বর্তমানে, সার্ফিং একটি পর্যটন কেন্দ্র এবং জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শার্লট ব্যানফিল্ডের জীবনেও সার্ফিংয়ের পথ মসৃণ ছিল না।
২০২১ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রতিযোগিতায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর মৃগীরোগ নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত তাকে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিষেধ করা হয়।
এতে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন এবং আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে, সমুদ্র সবসময় তাকে শান্ত থাকতে শিখিয়েছে।
বর্তমানে, তিনি আবার প্রতিযোগিতায় ফিরে এসেছেন এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।
শার্লট বলেন, “খারাপ দিনগুলোতে আমি আমার সার্ফবোর্ড নিয়ে সমুদ্রে যাই।” অভিজ্ঞ সার্ফার রবিন ডেভিসের মতে, সার্ফিং একটি আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা।
প্রকৃতির কাছে মানুষ নগণ্য, এই অনুভূতিটি সার্ফিংয়ে খুব দ্রুত উপলব্ধি করা যায়।
সার্ফিং একইসঙ্গে যেমন বিপজ্জনক, তেমনই উত্তেজনাপূর্ণ।
রবিন জানিয়েছেন, সমুদ্রের গভীরে শিলার সঙ্গে ধাক্কা লেগে একবার তিনি প্রায় ডুবে যাচ্ছিলেন। এছাড়াও, তিনি বিভিন্ন সময়ে হাঙর এবং তিমি মাছের কাছাকাছি এসেছেন।
এমনকি, একবার সিল মাছ তার পায়ের আঙুল কামড়ে ধরেছিল!
কর্নোয়ালের এই প্রদর্শনীতে সার্ফিংয়ের গত ১০০ বছরের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের সার্ফবোর্ড ও সরঞ্জাম রয়েছে।
প্রদর্শনীটি ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে ২০২৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চলবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান