বেলজিয়াম সাম্রাজ্যের শাসনে রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর মাটিতে জন্ম নেওয়া মেটিস শিশুদের (ইউরোপীয় ও আফ্রিকান মিশ্র বংশোদ্ভূত) প্রতি হওয়া অবিচার ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। আল জাজিরায় প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এই ঘটনার মর্মস্পর্শী কাহিনি তুলে ধরা হলো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপনিবেশ ভাঙতে শুরু করলেও, এর ক্ষত আজও অনেক জাতির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। বেলজিয়াম তার কলোনিগুলোতে, বিশেষ করে রুয়ান্ডা ও কঙ্গোতে, মেটিস শিশুদের প্রতি যে আচরণ করেছিল, তা ছিল সেই সময়ের অন্যতম ঘৃণ্য দৃষ্টান্ত।
এই শিশুদের পরিচয় ছিল অনিশ্চিত, তারা শ্বেতাঙ্গ শাসকদের চোখে ছিল অবাঞ্ছিত এবং তাদের মায়েদের কাছে তারা ছিল ভালোবাসার আশ্রয়স্থল।
রুয়ান্ডার কিগালি শহরে জন্ম নেওয়া এক নারীর কথা ধরা যাক। তাঁর মা ছিলেন আফ্রিকান, বাবা ছিলেন বেলজিয়ান। শৈশবে বাবাকে হারানোর পর বেলজিয়ান কর্তৃপক্ষ তাঁর ভাইকে ক্যাথলিক বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেয়, মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে।
এই শিশুদের শ্বেতাঙ্গ সমাজের সঙ্গে মিশে যাওয়া আটকাতে, তাদের পরিবার থেকে আলাদা করে দেওয়া হতো। এই শিশুদের “মানবিক খচ্চর” বা “অর্ধেক জাতের” মতো বিভাজন করে দেখা হতো, যা তাদের পরিচয় সংকটে ফেলত।
মায়ের কোনো অনুমতি ছাড়াই শিশুদের কাছ থেকে তাদের মায়েদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হতো।
ছোট্ট মেয়েটি, যার নিজের মা-বাবার পরিচয় নিয়ে কোনো ধারণা ছিল না, কয়েক বছর পর জানতে পারে, কীভাবে তাকে তার পরিবার থেকে আলাদা করা হয়েছিল। তাকে এবং তার বোনকে একটি “মিশ্র-জাতি” শিশুদের প্রতিষ্ঠানে পাঠানো হয়।
পরে তাদের বেলজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার একটি পরিবারে আশ্রয় হয় তার। পরিবারগুলো সাধারণত শিশুদের বিভক্ত করে রাখত, যা তাদের মানসিক বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছিল।
ফস্টার পরিবারে থেকেও মেয়েটি একাকীত্বে ভুগছিল। সৎ বাবার কাছে কিছুটা আশ্রয় পেলেও, পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে সে ছিল বিচ্ছিন্ন।
১১ বছর বয়সে, সে তার নথি খুঁজে বের করে এবং জানতে পারে, জন্মসনদে তাকে “অবৈধ সন্তান” হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই ঘটনা তাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়।
এরপর তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ঘেন্ট শহরে যান। সেখানে ছাত্র আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনে অংশ নিতে শুরু করেন।
তিনি উপলব্ধি করেন, মানুষের অধিকারের জন্য লড়াই করা তাঁর জীবনের একটি অংশ। কর্মজীবনের পাশাপাশি তিনি অতীতের ঘটনাগুলো জানার চেষ্টা করতে থাকেন।
পরবর্তীতে তিনি তাঁর ভাই ও বোনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হন। তবে মায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক স্থাপন করা কঠিন ছিল।
মায়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি জানতে পারেন, তাঁর মা নতুন করে সংসার পেতেছেন এবং তাঁর আরও সন্তান রয়েছে। এই ঘটনা তাঁর মনে গভীর আঘাত হানে।
মেটিস শিশুদের নিয়ে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিয়ে, তিনি বেলজিয়ান উপনিবেশবাদের শিকার হওয়া আফ্রিকানদের ওপর গবেষণা শুরু করেন। আর্কাইভ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা সহজ ছিল না, তবে তাঁর অধ্যবসায়ের ফলে তিনি সফল হন।
তিনি মেটিস শিশুদের একত্রিত করে তাদের অভিজ্ঞতা শোনানোর ব্যবস্থা করেন এবং তাদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হন।
২০১০ সালে, ঘেন্ট শহরের উৎসবে “বেলজিয়ান উপনিবেশের মিশ্র জাতি” বিষয়ক একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এরপর প্রকাশিত হয় “উপনিবেশের জারজ সন্তান” (The Bastards of Colonisation) নামে একটি বই।
এই বই এবং প্রদর্শনী ব্যাপক সাড়া ফেলে। এই ঘটনার ফলস্বরূপ, বেলজিয়াম সরকার তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়।
মেটিস শিশুরা তাঁদের অতীতের ঘটনার ক্ষতিপূরণ এবং তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্য এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। এই লড়াইয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা।
তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, পরিচয়হীনতা, বিচ্ছিন্নতা এবং অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করা কতটা কঠিন।
এই ঘটনা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল আজও অনেক সমাজে বিদ্যমান। এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে জন্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং মানুষের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা