লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের জেরে বিমান চলাচলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের সাব স্টেশনে লাগা এই আগুনে ১৩০০ এর বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে, যার ফলে কয়েক লক্ষ যাত্রীর ভ্রমণ বাতিল অথবা বিলম্বিত হয়েছে।
এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে, অতীতে হওয়া কয়েকটি বড় বিমান চলাচল বিঘ্নিত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরা হলো, যা আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
সাম্প্রতিক সময়ে, প্রযুক্তিগত ত্রুটিগুলি বিমান চলাচলে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। যেমন, গত জুলাই মাসে, CrowdStrike নামক একটি সাইবার নিরাপত্তা সংস্থার তৈরি করা সফটওয়্যার আপডেটের কারণে বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তিগত গোলযোগ দেখা দেয়।
এর ফলে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স তাদের টিকিট বুকিং সিস্টেমে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়, হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল হয় এবং কয়েক হাজার ফ্লাইট দেরিতে চলে। এর ফলস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, এশিয়া এবং ল্যাটিন আমেরিকার বিমানবন্দরগুলোতে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।
২০২৩ সালের আগস্ট মাসে, ব্রিটেনের ন্যাশনাল এয়ার ট্রাফিক সার্ভিসের (NATS) ত্রুটির কারণে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে ম্যানুয়ালি কাজ করতে হয়, স্বয়ংক্রিয়ভাবে নয়।
গ্রীষ্মের ছুটির সময়ে কয়েকশ ফ্লাইট বাতিল বা বিলম্বিত হয়। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে চালু হওয়ার পর থেকেই NATS সিস্টেমে সফটওয়্যার সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয়।
কোভিড-১৯ মহামারী বিশ্বে বিমান চলাচলে এক অভূতপূর্ব সংকট তৈরি করেছিল। ২০২০ সালের শুরুতে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পরে, বিশ্বের প্রায় সব বিমানবন্দরের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
অনেক দেশ তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দেয় এবং ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এপ্রিল মাসের মধ্যে, বিশ্বজুড়ে বিমানের সংখ্যা ৮০ শতাংশ কমে গিয়েছিল।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর মাস্ক পরা, কোভিড টেস্ট করানোসহ বিভিন্ন বিধিনিষেধের কারণে আকাশপথে ভ্রমণ আগের চেয়ে কঠিন এবং ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে। অবশেষে, ২০২৪ সালে গিয়ে যাত্রী সংখ্যা ২০১৯ সালের পর্যায়ে পৌঁছায়।
এর আগে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে, লন্ডনের গ্যাটউইক বিমানবন্দরে ড্রোন ওড়ার কারণে বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কয়েক ডজন ড্রোন শনাক্ত হওয়ার পর ব্রিটেনের দ্বিতীয় ব্যস্ততম এই বিমানবন্দরটি টানা তিন দিন বন্ধ ছিল, যার ফলে প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার যাত্রী আটকা পড়েছিলেন।
দীর্ঘ তদন্তের পরও পুলিশ অপরাধীদের শনাক্ত করতে পারেনি।
এছাড়াও, ২০১৭ সালের মে মাসে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ডেটা সেন্টারে কম্পিউটার ত্রুটির কারণে হিথ্রো এবং গ্যাটউইক থেকে সব ফ্লাইট বাতিল করতে হয়। প্রায় ৭৫ হাজার যাত্রী এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হন।
এর আগে, ২০১৬ সালের আগস্টে, ডেল্টা এয়ারলাইন্সের একটি বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে গেলে তাদের ডেটা সেন্টারের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলশ্রুতিতে ২ হাজারের বেশি ফ্লাইট বাতিল করা হয় এবং প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার রাজস্ব ক্ষতি হয়।
আকাশপথে বিপর্যয়ের আরেকটি বড় উদাহরণ হলো ২০১০ সালের এপ্রিল মাসের ঘটনা। আইসল্যান্ডের Eyjafjallajökull (আইয়াফিয়ালায়েকুল) আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের কারণে সৃষ্ট ছাইয়ের মেঘে ইউরোপের আকাশপথ বন্ধ হয়ে যায়।
বিমান ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকার মধ্যে ফ্লাইট বাতিল করা হয়। এতে ১ লক্ষের বেশি ফ্লাইট বাতিল হয় এবং প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়।
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়। হাইজ্যাক করা বিমানগুলো ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং পেন্টাগনে আঘাত হানে।
হাজার হাজার ফ্লাইট বাতিল করা হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিকে আসা বিমানগুলোকে কানাডা ও মেক্সিকোতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর আকাশপথে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা হয়, যা ভ্রমণকারীদের জন্য আরও বেশি সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন করে তোলে।
এসব ঘটনা থেকে বোঝা যায়, বিমান চলাচলে বিঘ্ন ঘটলে তা বিশ্বজুড়ে ভ্রমণকারীদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। প্রযুক্তিগত ত্রুটি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সন্ত্রাসী হামলার মতো ঘটনার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিশেষ করে, যারা বিদেশ ভ্রমণ করেন, তাদের জন্য এই ধরনের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস