ব্রাজিলের ফুটবল তারকা দানিলো: পেপ গার্দিওলার ‘ব্রেইনওয়াশ’ থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা
ফুটবল বিশ্বে এমন খুব কম খেলোয়াড় আছেন যারা দানিলোর মতো এত বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং সফল ক্যারিয়ার গড়েছেন। ১৩ বছর ধরে ইউরোপে খেলার সময় পর্তুগাল, স্পেন, ইংল্যান্ড ও ইতালির মতো দেশগুলোতে লীগ খেতাব জিতেছেন তিনি।
বর্তমানে তিনি ব্রাজিলের ক্লাব ফ্লামেঙ্গোতে ফিরে এসেছেন, আরও ট্রফি জয়ের স্বপ্ন নিয়ে এবং ২০২৬ সালের বিশ্বকাপে ব্রাজিল দলে জায়গা করে নেওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
মাঠের বাইরের দানিলোও বেশ পরিচিত মুখ। সামাজিক মাধ্যমের নেতিবাচক দিক থেকে বাঁচতে তিনি দু’বার এর থেকে দূরে ছিলেন।
তরুণ বয়সে একবার বছরে একটিবার ব্যবহারের জন্য গাড়ি কিনেছিলেন, সেই বিষয়টি নিয়েও এখন অনুশোচনা হয় তার। খেলোয়াড় জীবন শেষে কোচিংয়ের পরিবর্তে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চান তিনি।
ম্যানচেস্টার সিটির বর্তমান ম্যানেজার পেপ গার্দিওলার কথা বলতে গিয়ে যেন অন্য মানুষ হয়ে উঠেন দানিলো। গার্দিওলার প্রশিক্ষণে খেলোয়াড়দের মধ্যে যে পরিবর্তন আসে, সে সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “পেপ গার্দিওলা তার খেলোয়াড়দের শিক্ষিত করেন।
তার কাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক এটিই। তিনি সব খেলোয়াড়কে একই দৃষ্টিতে ফুটবল সম্পর্কে চিন্তা করতে শেখান। সময়, স্থান, মুভমেন্ট, বলের দখল—এসবের প্রতি কিভাবে মনোযোগ দিতে হয়, সেটা তিনি শেখান।”
দানিলো আরও বলেন, “অন্য কোনো কোচের মধ্যে মাঠের স্থানগুলো সম্পর্কে এত ভালোভাবে বুঝানোর ক্ষমতা দেখিনি। খেলার আবেগটাও তিনি অন্যরকমভাবে অনুভব করেন।
আমি বলতে পারি, গার্দিওলার দ্বারা আমি ‘ব্রেইনওয়াশড’ হয়েছি, তবে ভালো অর্থে। এটা অনেকটা ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার মতো ছিল। তার সঙ্গে কাজ করার কারণে আমি আমার খেলার মান অনেক উপরে নিয়ে যেতে পেরেছি এবং আজও সেই মান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
ম্যানচেস্টার সিটিতে আসার আগে আমি যে একেবারে বোকা ছিলাম, তা নয়। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আমি ভুলভাবে ফুটবল খেলতাম।
যদি আগে তার সঙ্গে দেখা হতো, তাহলে আমার জীবনটা আরও সহজ হতো। আমি খুব খুশি যে তার অধীনে খেলতে পেরেছি এবং তার কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।”
গার্দিওলার প্রভাব কতটা গভীর ছিল, দানিলোর কথাগুলো তারই প্রমাণ। এমনকি যারা ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি সময়ে ছিলেন, তাদের উপরেও ছিল তার দারুণ প্রভাব।
২০১৭ সালে যখন তিনি ইতিহাদ স্টেডিয়ামে এসেছিলেন, তখন কিন্তু তিনি নতুন ছিলেন না। এর আগে তিনি ব্রাজিলের ক্লাব সান্তোস, পর্তুগালের পোর্তো এবং স্পেনের রিয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবে খেলেছেন।
রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে তিনি জিনেদিন জিদানের অধীনে দুটি চ্যাম্পিয়ন্স লিগও জিতেছেন।
ম্যান সিটিতে কাটানো দুই মৌসুমে তিনি লিগ জিতেছেন এবং ৬০টি ম্যাচে অংশ নিয়েছিলেন।
২০১৭-১৮ মৌসুমে সিটি ১০০ পয়েন্ট অর্জন করে দ্বিতীয় স্থানে থাকা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের চেয়ে ১৯ পয়েন্ট এগিয়ে ছিল।
পরের মৌসুমে অবশ্য লিভারপুল বেশ ভালো প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছিল, এবং সিটি এক পয়েন্টের ব্যবধানে জয়ী হয়েছিল।
ফুটবলে সময়ের পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করে দানিলো বলেন, “আমাদের মনে রাখতে হবে, ফুটবল একটি চক্রের মতো।
এমন অনেক খেলোয়াড় আছে যাদের বয়স এখন ৩৩ বা ৩৪ বছর, যারা আট, নয় বা ১০ বছর ধরে শীর্ষ পর্যায়ে খেলছে।
পারফরম্যান্সে এই পতন স্বাভাবিক। মানসিক দিকটাও দেখতে হবে। বয়সের কথা বললে, এটা শারীরিক বিষয় নয়।
এত বছর ধরে এত চাপের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা, সবসময় জেতার চাপ—এগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।”
নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও কথা বলেছেন এই ডিফেন্ডার। তিনি চান না ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত খেলে যান।
মাঠের বাইরে নিজের জীবনটা উপভোগ করতে চান তিনি, যা তিনি ইউরোপে থাকার সময় শিখেছেন।
তিনি আরও বলেন, “আমার আসল বিষয় ছিল আমি কে, সেটা বোঝা।
সমাজের স্রোতের সঙ্গে না হেঁটে, অন্য সবার মতো চিন্তা না করে, তাদের মতো পোশাক না পরে বা তাদের মতো কথা না বলেও জীবন কাটানো যায়।”
নিজের গাড়ির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “আমি যখন পোর্তোতে খেলতাম, তখন বছরে একবার ব্রাজিলে আসতাম।
৫০০,০০০ রিয়াল (প্রায় ৯২ লাখ টাকা) দিয়ে একটা ক্যামারো কিনেছিলাম। পরে দেখি, গাড়িটা আমার জন্মস্থান বিকাসে (একটি ছোট শহর) পড়ে আছে।
বিকাসে ক্যামারো দিয়ে কি হবে? ফুটবলার হওয়ার কারণে সুন্দর গাড়ি রাখার একটা সামাজিক চাপ ছিল। কিন্তু ১০ বছর আগের আমাকে দেখলে এখন হাসি পায়।”
মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দানিলো জানান, রিয়াল মাদ্রিদে খেলার সময় তিনি হতাশায় ভুগতেন।
তিনি বলেন, “রিয়াল মাদ্রিদ ছিল এই সমস্যার চূড়ান্ত পর্যায়, কারণ এটি বিশ্বের সেরা ক্লাব।
আমি এতটাই ভুগেছি যে মনোবিদের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এমন সময়ও গেছে যখন মনে হয়েছে আমি যেন ফুটবল খেলতেই ভুলে গেছি।
সমালোচনায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আমি সমালোচনার কাছে, সোশ্যাল মিডিয়ার কাছে, সবকিছুর কাছে বন্দী হয়ে গিয়েছিলাম।
তখনই আমি একজন ক্রীড়া মনোবিদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করি।”
দানিলো আরও মনে করেন, ক্লাবগুলোর উচিত খেলোয়াড়দের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরও বেশি কাজ করা।
কারণ অনেক খেলোয়াড় আছেন যারা তরুণ বয়সে তারকাখ্যাতি পেলেও মানসিক সমস্যার কারণে পেশাদার পর্যায়ে ভালো করতে পারেন না।
২০২০ সালে দানিলো ‘ভোজ ফিউচরা’ নামে একটি প্রকল্প শুরু করেন, যার মাধ্যমে তিনি মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা এবং আত্ম-অনুসন্ধানে উৎসাহিত করেন।
বর্তমানে তিনি ফ্লামেঙ্গোর হয়ে খেলছেন। এছাড়াও ব্রাজিলের জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন।
তার মতে, দেশে ফিরে আসার কারণে তিনি সমর্থকদের আরও কাছে আসতে পারবেন এবং জাতীয় দলে নিজের জায়গা আরও সুসংহত করতে পারবেন।
ফ্লামেঙ্গোতে তিনি ফিলিপে লুইসের অধীনে খেলেন, যিনি তার চেয়ে মাত্র ছয় বছরের বড়।
ফিলিপে সম্প্রতি ফুটবল থেকে অবসর নিয়েছেন এবং বর্তমানে ফ্লামেঙ্গোর অনূর্ধ্ব-১৭ দলের কোচ হিসেবে কাজ করছেন।
দানিলো জানান, তিনি কখনোই কোচ হতে চান না।
কারণ খেলোয়াড় জীবন শেষে তিনি মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চান।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান