জাপানে বিতর্কিত ইউনিফিকেশন চার্চ বিলুপ্তির নির্দেশ দিয়েছে একটি আদালত। মঙ্গলবার টোকিও জেলা আদালত এই নির্দেশ দেন।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সূত্র ধরে সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খবর অনুযায়ী, এই চার্চের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে অনুসারীদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বনের অভিযোগ ছিল।
আদালতের এই রায়ের ফলে, চার্চটি তাদের করমুক্ত সুবিধা হারাবে এবং তাদের সম্পদ তরল করারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে, চার্চ কর্তৃপক্ষ তাৎক্ষণিকভাবে আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বিবেচনা করছে। তারা এই রায়কে ‘অন্যায়’ এবং ‘অগ্রহণযোগ্য’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
জাপানের শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে এই চার্চ বিলুপ্তির আবেদন জানিয়েছিল। মন্ত্রণালয় জানায়, চার্চটি তাদের অনুসারীদের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করে এবং তাদের পরিবারগুলোর ক্ষতিসাধন করে আসছিল। এছাড়া, তাদের অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে।
২০২২ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের হত্যাকাণ্ডের তদন্তে এই চার্চ এবং জাপানের ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে গভীর সম্পর্কের বিষয়টি সামনে আসে। জানা যায়, ১৯৬০-এর দশকে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নোবুসুকে কিসির আমলে এই চার্চটি জাপানে ধর্মীয় সংগঠন হিসেবে আইনি স্বীকৃতি লাভ করে।
আবের হত্যাকারীর পরিবারের আর্থিক সমস্যার জন্য তিনি এই চার্চকে দায়ী করেছিলেন।
ইউনিফিকেশন চার্চ, যা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ফ্যামিলি ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিস অ্যান্ড ইউনিফিকেশন’ নামে পরিচিত, এটি জাপানের দেওয়ানি আইনের অধীনে বিলুপ্তির নির্দেশ পাওয়া প্রথম ধর্মীয় সংগঠন। এর আগে, শুধুমাত্র দুটি ঘটনার ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছিল – একটি ছিল সারিন গ্যাস হামলা চালানো আওম শিনরিকিও এবং অন্যটি ছিল মায়োকাকুজি গোষ্ঠী, যাদের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ ছিল।
চার্চের বিলুপ্তি চেয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আদালতের কাছে প্রায় ৫০০০ নথি এবং ১৭০ জনের বেশি মানুষের সাক্ষ্য প্রমাণ জমা দিয়েছিল। অভিযোগ ছিল, চার্চটি তাদের অনুসারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিত, যা তাদের বেশি মূল্যের জিনিস কিনতে এবং সামর্থ্যের বাইরে দান করতে বাধ্য করত। এর ফলে তাদের পরিবারগুলোতে ভীতি ও ক্ষতির সৃষ্টি হতো।
জাপানের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংস্থা জানায়, আদালতের বাইরে এবং ভেতরে হওয়া সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রায় ২০০ বিলিয়ন ইয়েন (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা, বিনিময় হার ১ টাকা = ১.৪৩ ইয়েন ধরে) আদায় করা হয়েছে, যা ১৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে দেওয়া হবে।
ইউনিফিকেশন চার্চ ১৯৫৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রেভারেন্ড সান মিউং মুন। তিনি বাইবেলের নতুন ব্যাখ্যা এবং পরিবার-কেন্দ্রিক মূল্যবোধ প্রচার করতেন।
একসময় এই চার্চের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, রিচার্ড নিক্সন, রোনাল্ড রিগান ও জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের মতো প্রভাবশালী নেতাদের ভালো সম্পর্ক ছিল।
১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে এই চার্চের বিরুদ্ধে সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতারণামূলক কৌশল এবং তাদের মগজ ধোলাই করার অভিযোগ ওঠে। জাপানে, এই গোষ্ঠী ‘আধ্যাত্মিক পণ্য’ বিক্রির মাধ্যমে সদস্যদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায়ের জন্য সমালোচিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, তারা সদস্যদের কাছ থেকে মূল্যবান শিল্পকর্ম ও অলঙ্কার কিনতে বা চার্চের জন্য অনুদান সংগ্রহ করতে তাদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করত।
যদিও চার্চটি অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের কথা স্বীকার করেছে, তবে তারা দাবি করে, ২০০৯ সাল থেকে তারা তাদের কার্যক্রমের মান উন্নত করেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাপানের অনুসারীদের কাছ থেকে ১৯১০-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপের ওপর জাপানের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় তাদের পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের জন্য অর্থ পরিশোধ করতে বলা হতো। এছাড়া, বিশ্বব্যাপী চার্চের তহবিলের সিংহভাগ আসে জাপান থেকে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস