আফ্রিকার সাফারী শিল্পে কৃষ্ণাঙ্গদের মালিকানা: বঞ্চনার ইতিহাস ও পরিবর্তনের সূচনা।
আফ্রিকার পর্যটন খাতে সাফারী একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা। প্রতি বছর প্রায় ১,২০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি আয় হয় এই শিল্প থেকে। কিন্তু এই শিল্পের সিংহভাগই শ্বেতাঙ্গদের দখলে। আফ্রিকার দেশগুলোতে সাফারী ব্যবসার মাত্র ১৫ শতাংশের মালিক কৃষ্ণাঙ্গরা। এই বৈষম্যের মূল কারণ হলো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং পদ্ধতিগত কিছু জটিলতা।
বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে, বহিরাগতরাই এই সাফারী ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, যখন ইউরোপীয় অভিযাত্রী এবং আমেরিকানরা আফ্রিকা মহাদেশে এসেছিল, তখন থেকেই এই শিল্পের সূচনা হয়। তারা এখানে এসে শিকার করত এবং মানচিত্র তৈরি করত। আজও অনেক সাফারী লজ ও ক্যাম্পের মালিক প্রধানত শ্বেতাঙ্গ পুরুষরা, যাদের মূল গ্রাহক ধনী আন্তর্জাতিক পর্যটকরা।
কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। আফ্রিকার কিছু উদ্যোক্তা এই অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করছেন। তারা সাফারী ব্যবসার ধারণাটাই নতুন করে সাজাচ্ছেন, যেখানে স্থানীয় মানুষের ক্ষমতায়ন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং সংস্কৃতির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
জিম্বাবুয়ের বাসিন্দা ভিম্বাই মাসিইওয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাতোকো আফ্রিকা নামক একটি সাফারী কোম্পানি খুলেছেন। মাসিইওয়া প্রথম নারী যিনি একটি সাফারী লজের মালিক। তিনি তার দেশের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং তার কোম্পানিতে স্থানীয় মানুষের সুযোগ সুবিধার দিকে নজর রাখেন। তিনি মনে করেন, “মানুষকে ভালো দেখাশোনা করলে, তারা বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব বুঝবে এবং তাদের রক্ষা করতে চাইবে।”
আরেকজন উদ্যোক্তা হলেন বেক্স এনডলোভু। তিনি আগে একজন গাইড ছিলেন, পরে “আফ্রিকান বুশ ক্যাম্পস” (এবিসি) নামে একটি সাফারী কোম্পানি খোলেন। তাঁর এই কোম্পানিটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়নের ওপর জোর দেয়। এনডলোভুর মতে, “সুন্দর জাতীয় উদ্যানগুলোর বাইরে দারিদ্র্য এবং বন্যপ্রাণীর ওপর বছরের পর বছর ধরে চলা অত্যাচারের দৃশ্য আমাকে খুব কষ্ট দিত।”
তবে এই পথে আসাটা মোটেও সহজ ছিল না। জিম্বাবুয়ের অর্থনৈতিক সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শুরুতে অনেক ক্লায়েন্ট দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তাছাড়া, একটি কৃষ্ণাঙ্গ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করা কতটা নিরাপদ, তা নিয়েও অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল।
উগান্ডা, রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর সীমান্তবর্তী এলাকায় মাউন্ট গাহিঙ্গা লজ খোলেন প্রবীণ মোমান। তাঁর এই যাত্রা সহজ ছিল না। রুয়ান্ডার গণহত্যার কয়েক বছর পরই তিনি ব্যবসা শুরু করেন। কর্মী খুঁজে পাওয়াও কঠিন ছিল, কারণ হয় তারা দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, না হয় মারা গিয়েছিল। মোমান তাই বাইরের লোকজনের উপর নির্ভর না করে স্থানীয়দের দক্ষ করে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি তাঁর কর্মীদের প্রশিক্ষিত করেন এবং তাদের ম্যানেজার ও নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ দেন। বর্তমানে ভলকানোস সাফারিস-এর তিনটি গরিলা লজ এবং দুটি শিম্পাঞ্জি লজ রয়েছে, যেখানে ৩০০ জন স্থানীয় কর্মী কাজ করেন।
এই সমস্ত সাফারী কোম্পানি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, বন্যপ্রাণী না থাকলে পর্যটনও টিকবে না। তারা স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ এবং অনুদানের ব্যবস্থা করে।
আফ্রিকার আদিবাসী বাত্বা সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও এই সাফারী কোম্পানিগুলো কাজ করছে। একসময় বাত্বা সম্প্রদায়ের মানুষ শিকার ও বন থেকে খাবার সংগ্রহ করে জীবন চালাত। ১৯৯০-এর দশকে তাদের আদি বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হয়। মোমান তাদের দুর্দশা দেখে মর্মাহত হন। তিনি তাদের জন্য গাহিঙ্গা বাত্বা গ্রাম তৈরি করেন, যেখানে স্থায়ী আবাস, একটি কমিউনিটি সেন্টার এবং চাষাবাদের জন্য জমি তৈরি করা হয়।
বাতোকো আফ্রিকা স্থানীয় অর্থনীতির উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এবিসি স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গাইড হিসেবে নিয়োগ করে, যা ঐতিহ্যগতভাবে পুরুষদের একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। এনডলোভুর মতে, “আমাদের গল্পটা তাদের মতো দেখতে, তাদের মতো কথা বলা একজন মানুষ বলবে, যা অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে এবং এই শিল্পে আরও বেশি মানুষকে কাজ করতে উৎসাহিত করবে।”
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক