দক্ষিণ কোরিয়ার এক সময়ের বিদেশি দত্তক প্রক্রিয়া নিয়ে ওঠা গুরুতর অভিযোগের তদন্ত শেষে দেশটির সরকারকেই দায়ি করেছে একটি সত্য উদ্ঘাটন কমিশন। ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে, যখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে দক্ষিণ কোরিয়া বিদেশি দত্তক প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করে, সেই সময়ে শিশুদের অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছিল বলে জানানো হয়েছে।
কমিশন বলছে, দরিদ্র শিশুদের জন্য একটি শক্তিশালী সমাজকল্যাণ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিবর্তে, সরকার বিদেশি দত্তক নেওয়ার প্রবণতাকে সমর্থন জুগিয়েছিল, যা পরবর্তীতে শিশুদের জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে, শিশুদের জন্মপরিচয় সংক্রান্ত তথ্য গোপন করা হতো, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তাদের আসল অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেও দেওয়া হয়নি।
সরকারি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে থাকা বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রায়ই শিশুদের সম্পর্কে ভুল তথ্য দিত। এর ফলে, অনেক দত্তক নেওয়া শিশুর শিকড় খুঁজে বের করা কঠিন হয়ে পড়ে।
কমিশন এই বিষয়ে ৩ বছর ধরে চলা তদন্তে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করা ৩৭৭ জন দত্তক নেওয়া ব্যক্তির অভিযোগ খতিয়ে দেখে।
এর মধ্যে ৫৬টি ক্ষেত্রে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেছে। কমিশনের চেয়ারপার্সন, সান ইয়ং পার্ক জানিয়েছেন, তাদের অনুসন্ধানে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে যোগসাজশের প্রমাণ মিলেছে।
তদন্তে আরো জানা যায়, বিদেশি দম্পতিদের কাছে শিশুদের দত্তক দেওয়ার ক্ষেত্রে এজেন্সিগুলো অভিভাবকদের সম্মতি ছাড়াই শিশুদের অন্য দেশে পাঠিয়ে দিত।
অনেক ক্ষেত্রে, শিশুদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেওয়া হতো। যেমন, যাদের বাবা-মা আছে, তাদেরও এতিম হিসেবে দেখানো হতো। এমনকি শিশুদের পরিচয়ও পরিবর্তন করে দেওয়া হতো।
কমিশনের একজন সদস্য, সাং হুন লি এই বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় অনেক অভিযোগ বিবেচনা করা সম্ভব হয়নি।
তিনি জানান, কিছু সদস্য শিশুদের দত্তক সংক্রান্ত নথিতে ভুল প্রমাণ করতে না পারায়, তাদের অভিযোগগুলো গ্রহণ করতে রাজি হননি।
এই ঘটনার শিকার হওয়া একজন, ইয়ুরি কিম জানান, ১১ বছর বয়সে তিনি তার বাবা-মায়ের সম্মতি ছাড়াই একটি দত্তক এজেন্সির মাধ্যমে ফ্রান্সে যান।
তিনি কমিশনের কাছে আবেদন করেছেন, ভবিষ্যতে যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, যারা এই ধরনের অন্যায় আচরণের শিকার হয়েছেন, তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত।
বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার দত্তক প্রক্রিয়া অনেক উন্নত হয়েছে। ২০১১ সালের একটি আইনের মাধ্যমে বিদেশি দত্তক নেওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের অনুমোদন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
ফলে, বিদেশি দত্তক গ্রহণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে এসেছে। তবে, অতীতে সংঘটিত অনিয়মের কারণে এখনো অনেক দত্তক নেওয়া ব্যক্তি তাদের পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারছেন না।
কমিশন এখন সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে, দত্তক নেওয়া শিশুদের নাগরিকত্বের সমস্যাগুলো সমাধানে পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো এখনো পর্যন্ত কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস