মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রুক্ষ, বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বুক চিরে যাওয়া এক ঐতিহাসিক রাস্তার নাম হল রুট ৬৬। স্বাধীনতার প্রতীক, অ্যাডভেঞ্চার আর ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর স্বপ্ন নিয়ে ১৯২৬ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল এই রাস্তার।
শুরুতে ২,৪০০ মাইলের বেশি দীর্ঘ এই রাস্তাটি উত্তর-পূর্বের লেক মিশিগান থেকে বিস্তৃত হয়ে পশ্চিমের হলিউড এবং প্রশান্ত মহাসাগরের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা ছোট ছোট রেস্তোরাঁ, গ্যাস স্টেশন আর মোটেলগুলো পথচারীদের সুবিধার জন্য তৈরি হয়েছিল।
তবে ১৯৫০-এর দশকে পরিবার-কেন্দ্রিক ভ্রমণের ধারণা জনপ্রিয় হওয়ার পরেই এই রাস্তার খ্যাতি আরও বাড়ে।
যদিও ১৯৮৫ সালে আধুনিক মহাসড়কের কারণে রুট ৬৬ তার পথ হারায়, কিন্তু এর আকর্ষণ আজও অটুট। এখনো পর্যন্ত রাস্তার প্রায় ৮৫ শতাংশ পথ ব্যবহারযোগ্য।
যারা একবার এই পথে পা রাখেন, তারা যেন এক ভিন্ন জগৎ খুঁজে পান। অ্যারিজোনা রাজ্যে, এই রাস্তাটি নিউ মেক্সিকো সীমান্ত থেকে কিংম্যান পর্যন্ত প্রায় ৩৮৫ মাইল পথ ধরে বিস্তৃত।
এই পথেই রয়েছে সেলগম্যানের কাছে ক্রুকটন রোড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া সীমান্ত পর্যন্ত ১৫৮ মাইলের দীর্ঘ, অবিচ্ছিন্ন রাস্তা, যা বিখ্যাত লেখক জন স্টাইনবেকের চোখে ‘মাদার রোড’ নামে পরিচিত।
এই রাস্তা ধরে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা পাঁচটি অংশে ভাগ করা যায়। প্রতিটি অংশে রয়েছে ঐতিহাসিক স্থান, সংরক্ষিত শহর এবং দর্শনীয় জাতীয় উদ্যান। রুক্ষ মরুভূমি, পাহাড় আর বিশাল সমতল ভূমি পেরিয়ে এই যাত্রা যেন এক স্বপ্নের মতো।
প্রথমেই আসা যাক অ্যারিজোনার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত লুpton-এ। এখানে নাভাজো জাতির লাল বেলেপাথরের পাহাড়গুলি যেন স্বাগত জানায়। এখানকার টিপি ট্রেডিং পোস্টের মতো দোকানগুলোতে আদিবাসী আমেরিকানদের শিল্পকর্ম দেখা যায়।
এরপর যাওয়া যায় পেট্রিফাইড ফরেস্ট ন্যাশনাল পার্কে (Petrified Forest National Park)। এখানে প্রায় ২০০ মিলিয়ন বছর আগের জীবাশ্ম, প্রাচীন চিত্রলিপি এবং রঙিন ভূমি দেখা যায়।
এরপর উইন্সলো (Winslow) শহরের দিকে যাত্রা। এই শহরটি ‘ইগলস’ ব্যান্ডের ‘টেক ইট ইজি’ গানের জন্য বিখ্যাত। শহরের ‘স্ট্যান্ডিং অন দ্য কর্নার পার্ক’-এ লাল রঙের একটি পুরনো ফোর্ড ট্রাক রয়েছে, যা ছবি তোলার জন্য আদর্শ।
উইন্সলো থেকে ২৫ মাইল পশ্চিমে রয়েছে ‘মেটিওর ক্রেটার ন্যাচারাল ল্যান্ডমার্ক’। এখানে প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে একটি উল্কাপাত হয়েছিল, যা হিরোসিমা-য় ফেলা বোমার থেকেও ১৫০ গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল।
ফ্ল্যাগস্টাফ (Flagstaff) হল অ্যারিজোনার রুট ৬৬-এর সবচেয়ে বড় শহর। এখানে ১৯৩০ সালে প্লুটো আবিষ্কার করা হয়েছিল, যা এখানকার ‘লোয়েল অবজারভেটরি’-তে আজও দেখা যায়।
এখানকার রাতের আকাশ এতটাই পরিষ্কার যে, শহরটিকে বিশ্বের প্রথম ‘ডার্ক স্কাই সিটি’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
ফ্ল্যাগস্টাফ থেকে একটু দূরেই রয়েছে ককুনিনো ন্যাশনাল ফরেস্ট (Coconino National Forest)। এখানে হাইকিং, বাইকিং এবং স্কিইং-এর সুযোগ রয়েছে। এর বাইরে ৭০ মাইল উত্তরে গেলে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ন্যাশনাল পার্ক-এর দেখা পাওয়া যায়।
গভীর গিরিখাত আর কলোরাডো নদীর দৃশ্য মুগ্ধ করার মতো।
সেলিগম্যান (Seligman) শহরের পুরনো অংশে গেলে রুট ৬৬-এর আসল স্বাদ পাওয়া যায়। এখানে রয়েছে অ্যাঞ্জেল ডেলগাদিলোর তৈরি করা ‘হিস্টোরিক রুট ৬৬ অ্যাসোসিয়েশন’। এখানকার ‘ডেলগাদিলোস স্নো ক্যাপ ড্রাইভ-ইন’-এ বার্গার ও মিল্কশেক-এর স্বাদ নেওয়া যেতে পারে।
কিংম্যান (Kingman) শহরটি ঐতিহাসিক রুট ৬৬-এর কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে রাস্তার ১০০ বছরের ইতিহাস নিয়ে একটি জাদুঘর রয়েছে। এছাড়া শহরের কেন্দ্রস্থলে স্থানীয় শিল্পীদের আঁকা অনেক সুন্দর চিত্রকর্ম দেখা যায়।
অ্যারিজোনার রুট ৬৬-এর শেষ গন্তব্য হল ওটম্যান (Oatman)। এখানকার রাস্তাটি সবচেয়ে সংকীর্ণ এবং খাড়া। এখানকার বন্য গাধাগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়।
এখানে ‘ওটম্যান হোটেল’-এর দেয়ালে ডলারের নোট লাগানোর একটা ঐতিহ্য রয়েছে।
সবশেষে, টপক (Topock) শহরে পৌঁছে এই যাত্রা শেষ করা যায়। এখানে ‘ওল্ড ট্রেইলস ব্রিজ’-এর পাশে দাঁড়ালে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি হয়।
যারা প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসেন, তারা এখানকার বিভিন্ন আদিবাসী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ঘুরে আসতে পারেন। যেমন – মন্টুমা ক্যাসেল, হাভাসু জলপ্রপাত, এবং ওয়ালনাট ক্যানিয়ন।
এই রুট ৬৬-এর অভিজ্ঞতা যেন এক স্বপ্নের মতো। যারা ভ্রমণের ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি একটি অসাধারণ সুযোগ।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক