প্যারিসের ল্যুভর জাদুঘর, শিল্পকলার এক বিশাল ভাণ্ডার। শুধু চিত্রকর্ম বা ভাস্কর্যের জন্যই নয়, খাদ্যরসিকদের জন্যও এটি এক অসাধারণ গন্তব্য।
ফ্রান্সের এই বিখ্যাত জাদুঘরে, খাবারের অন্বেষণে বেরিয়ে পড়াটাও একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হতে পারে। সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন ল্যুভরকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা করেছেন, যেখানে মোনালিসার জন্য একটি আলাদা ঘর তৈরি করা হবে।
খবরটি নিশ্চয়ই অনেকের ভালো লেগেছে।
ল্যুভরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে আছে খাদ্য ও সংস্কৃতির নানা নিদর্শন। ইতালীয় রেনেসাঁর সময়কার শিল্পী পাওলো ভেরোনিজের আঁকা বিশাল চিত্রকর্ম ‘ক্যানার বিবাহভোজ’-এ খাদ্যরসিকদের জন্য অনেক কিছুই মজুত রয়েছে।
মোনালিসা যে ঘরে থাকবেন, তার ঠিক উল্টো দিকেই রয়েছে এই ছবি। ছবিতে যিশু খ্রিস্টের প্রথম অলৌকিক ঘটনার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, যেখানে তিনি পানিকে ওয়াইনে পরিণত করেছিলেন।
ছবিতে ভেনিসের একটি প্রাসাদ দেখানো হয়েছে, যেখানে সেই সময়ের মানুষের পোশাক ও ভোজের আয়োজন দেখা যায়। টেবিলে সাজানো ছিল নানা ধরনের খাবার – ফল, মিষ্টি এবং সুস্বাদু খাদ্য।
প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার দিকে তাকালে, সেখানেও খাবারের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। প্রিন্সেস নেফারতিয়াবেতের সমাধির পাথরের গায়ে আঁকা ছবিতে দেখা যায়, তিনি একটি আসনে বসে আছেন এবং তার সামনে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
সাদা রুটি, মাংস, ফল, পানীয়—এসবের মাধ্যমে পরকালের জীবনকেও উপভোগ করার ধারণা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
সময় আরও কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে গেলে, মেসোপটেমীয় সভ্যতার নিদর্শন মেলে। হাম্মুরাবির আইন সংহিতার পাশের একটি কাঁচের বাক্সে পাওয়া যায় প্রায় ৩,৮০০ বছর আগের একটি বাটির সন্ধান।
বাটিটিতে বিভিন্ন পশুর ছবি খোদাই করা ছিল। এই ধরনের বাটি সাধারণত মিষ্টি বা খাবার তৈরির জন্য ব্যবহার করা হতো।
ল্যুভরের সংগ্রহে শুধু ছবি বা ভাস্কর্যই নয়, খাবারের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত নানান জিনিসও রয়েছে।
যেমন, ষোড়শ শতাব্দীর একটি চামচ ও কাঁটা চামচের সেট, যা রক ক্রিস্টাল দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এটি সিলন (বর্তমান শ্রীলঙ্কা)-এর কারিগরদের তৈরি করা, যা তখনকার রাজকীয় আভিজাত্যের প্রতীক ছিল।
ল্যুভরের অ্যাপোলো গ্যালারিতে ফ্রান্সের রাজকীয় মুকুটমণি রাখা আছে। এখানে সোনার তৈরি নানান পাত্র দেখা যায়, যা রাজা চতুর্দশ লুইয়ের আড়ম্বরপূর্ণ ভোজের স্মৃতি বহন করে।
খাদ্য পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত এই পাত্রগুলোতে রাজার ঐশ্বর্য ফুটে ওঠে।
ইসলামিক গ্যালারিতেও খাবারের সাথে সম্পর্কিত অনেক জিনিস দেখা যায়। সেখানে সিরামিকের প্লেট, জেড বাটি, কাঁচের বোতল ও ধাতব পাত্র রয়েছে।
একটি পারস্যের প্লেটে (Denon wing, room 185) হাতে লেখা ছিল, “এই প্লেটটি যেন সবসময় ভরে থাকে, বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে, যেখানে কারো কোনো অভাব নেই এবং সবাই সবকিছু উপভোগ করে।”
ল্যুভর যেন শিল্পী ও খাদ্য প্রস্তুতকারকদের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। শিল্পী যেমন রং ও তুলির মাধ্যমে ছবি তৈরি করেন, তেমনি খাদ্য প্রস্তুতকারক তার হাতের ছোঁয়ায় কাঁচামাল থেকে সুস্বাদু খাবার তৈরি করেন।
উভয়ই তাদের কাজে সমান মনোযোগ দেন, যা তাদের সৃষ্টিকে অনন্য করে তোলে।
এই জাদুঘরের খাদ্য বিষয়ক ছবিগুলো দর্শকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে। উদাহরণস্বরূপ, জ্যাঁ-বাপতিস্ত-সিমিয়ন শার্দাঁর আঁকা ‘দ্য ব্রিয়োশ’ (The Brioche) ছবিটির কথা বলা যায়।
ছবিটিতে দেখা যায় একটি গোল আকারের রুটি, যা সম্ভবত একটু বেশি পুড়ে গেছে। ছবিটির দিকে তাকালে সময়ের পরিবর্তনের ধারণা পাওয়া যায়।
ল্যুভর পরিদর্শনের সময়, খাদ্য ও শিল্পের এই মেলবন্ধন সত্যিই উপভোগ করার মতো।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক