যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতি: অন্য দেশগুলো কি সত্যিই ‘প্রতারণা’ করছে?
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর সঙ্গীদের বাণিজ্য নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্যের জেরে আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসন প্রায়ই অভিযোগ করে আসছে যে, অন্যান্য দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ‘প্রতারণা’ করছে। এই অভিযোগের ভিত্তিতে, তিনি বিভিন্ন দেশের ওপর শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চলুন, দেখা যাক, এই অভিযোগগুলোর সত্যতা কতটুকু।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির কেন্দ্রে রয়েছে শুল্ক (Shulko), যা আমদানি করা পণ্যের ওপর ধার্য করা হয়। ট্রাম্প প্রশাসন বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য ঘাটতিকে (Banijjo Ghaati) ‘প্রতারণা’ হিসেবে চিহ্নিত করে শুল্ক আরোপের পক্ষে যুক্তি দেখাচ্ছে। কিন্তু, বিশেষজ্ঞদের মতে, বাণিজ্য ঘাটতি একটি জটিল বিষয়, যা অনেক কারণের ওপর নির্ভর করে।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি থাকলেই যে সেই দেশটি ‘প্রতারণা’ করছে, এমনটা নাও হতে পারে। অনেক সময়, একটি দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, প্রাকৃতিক সম্পদ এবং অর্থনীতির আকারের কারণেও বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
যেমন, আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারের কথা ধরুন। এই দেশটি ভ্যানিলার (Vanilla) মতো কিছু বিশেষ পণ্য উত্পাদন করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খুবই প্রয়োজনীয়। ফলে, বাণিজ্য ঘাটতি হওয়াটা স্বাভাবিক।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতির মূল কারণগুলো হলো— বাজারের চাহিদা, পণ্যের উৎপাদন খরচ এবং বাজারের সরবরাহ ব্যবস্থা। কোনো দেশ যদি কম দামে (Dumping – ডাম্পিং) পণ্য বিক্রি করে, অথবা উত্পাদনকারীদের জন্য অতিরিক্ত ভর্তুকি (Bhortuki) দেয়, তবে বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
এছাড়া, মুদ্রা কারসাজির (Mudra Karshaji) মাধ্যমেও বাণিজ্যে প্রভাব সৃষ্টি করা যেতে পারে। তবে, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির জন্য দায়ী দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, এর অধিকাংশই ছোট এবং দরিদ্র। এই দেশগুলোর অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির তুলনায় অনেক দুর্বল।
উদাহরণস্বরূপ, লেসোথো (Lesotho), কম্বোডিয়া (Cambodia), এবং ভিয়েতনামের (Vietnam) মতো দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য করে। এই দেশগুলোর রপ্তানির পরিমাণ তাদের আমদানি থেকে বেশি, তাই তাদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত (Trade surplus) রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সরকার যদিও এই দেশগুলোর ওপর শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি হয়তো খুব বেশি কমবে না। কারণ, এই দেশগুলোর অর্থনীতি এতটাই ছোট যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না।
বাণিজ্য নীতি বিশ্লেষকদের মতে, বাণিজ্য ঘাটতি একটি জটিল বিষয়। একে শুধু শুল্ক আরোপের মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপ, যা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন মেনে নেওয়া উচিত।
বাণিজ্য ঘাটতির কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায়, অনেক সময় দেশের অভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ও এর জন্য দায়ী। যেমন, কোনো দেশের দুর্বল অবকাঠামো বা প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা বাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এছাড়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নীতিগত দুর্বলতাও বাণিজ্য ঘাটতির কারণ হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির এই দিকটি বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত রপ্তানি-নির্ভর। তাই, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নিয়মকানুন এবং শুল্কনীতি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত থাকা প্রয়োজন।
বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে, বাংলাদেশের বাণিজ্য খাতেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা