যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচেষ্টা: বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা ও চ্যালেঞ্জ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির উৎপাদন শিল্পকে (manufacturing sector) চাঙ্গা করতে শুল্ক আরোপের যে নীতি গ্রহণ করেছেন, তা কি সত্যিই সম্ভব? এই প্রশ্নটি এখন বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়। কারণ, আধুনিক প্রযুক্তির দুনিয়ায় কারখানার চিত্র বদলে গেছে, সেখানে শ্রমিকের বদলে জায়গা করে নিচ্ছে অত্যাধুনিক রোবট।
এই পরিস্থিতিতে, ট্রাম্পের পরিকল্পনা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাংলাদেশের জন্য এই খবরটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিশ্ব অর্থনীতির এই পরিবর্তন আমাদের দেশের শিল্পখাতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
১৯৭০ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের এক-চতুর্থাংশের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন উৎপাদন শিল্পে। বর্তমানে, এই সংখ্যাটি ৮ শতাংশের কাছাকাছি। ট্রাম্প প্রশাসনের দাবি, তারা শুল্ক আরোপের মাধ্যমে এই দীর্ঘদিনের পতন রুখতে পারবে।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং স্বয়ংক্রিয়তার (automation) কারণে, এখনকার কারখানাগুলোতে আগের মতো বিপুল সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয় না। ফলে, নতুন কারখানা তৈরি হলেও, সেখানে দক্ষ কর্মীর চাহিদা বাড়বে, যাদের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাকচারিং ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ক্যারোলিন লি-এর মতে, “উৎপাদন শিল্পের কাজের ধরন অনেক বদলে গেছে, এবং শ্রমিক চাহিদাও কমেছে।” এর কারণ হিসেবে তিনি কারখানায় প্রযুক্তির ব্যবহারকে প্রধান্য দেন।
উদাহরণস্বরূপ, এখনকার কর্মীদের সফটওয়্যার, ডেটা বিশ্লেষণ এবং কোডিংয়ের (coding) মতো বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হয়। এমনকি, কারখানার রোবট মেরামতের জন্যেও দক্ষ কর্মী প্রয়োজন।
ট্রাম্পের শুল্ক নীতির কারণে কিছু ব্যবসায়ী যেমন ক্ষতির শিকার হচ্ছেন, তেমনি এর ফলে বিশ্ব বাজারেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যা নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় আরও বেশি প্রভাব ফেলবে।
তবে, ট্রাম্পের এই নীতির সমর্থকরা বলছেন, এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কারখানাগুলোতে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হবে। এর ফলে, একদিকে যেমন কর্মসংস্থান বাড়বে, তেমনি দেশের অর্থনীতিও শক্তিশালী হবে।
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ছিল বিশ্বের শীর্ষ উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু গত ৫০ বছরে, এই শিল্প ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে, এবং অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়।
এর ফলে, দেশটির “রাস্ট বেল্ট” নামে পরিচিত অঞ্চলে (যেখানে একসময় শিল্পের জোয়ার ছিল) চরম অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়।
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্রে কারখানার কাজ করার মতো লোক পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি ২০২৫ পর্যন্ত, প্রায় ৪ লক্ষ ৮২ হাজার শূন্য পদ ছিল, যা পূরণ করার মতো পর্যাপ্ত কর্মী নেই।
ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ ম্যানুফ্যাকচারার্সের (NAM) ধারণা, ২০২৩ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১৯ লাখে পৌঁছাতে পারে।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হাস স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক ওলাফ গ্রোথের মতে, “যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকদের দক্ষতা এখনকার উৎপাদন শিল্পের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”
অন্যদিকে, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-এর (AI) কারণে অনেক শিল্পে কাজের ধরন বদলাতে শুরু করেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৪১ শতাংশ নিয়োগকর্তা এআই-এর কারণে তাদের কর্মী ছাঁটাই করার পরিকল্পনা করছেন।
ম্যানুফ্যাকচারিং ইনস্টিটিউটের ক্যারোলিন লি মনে করেন, “শিল্পক্ষেত্রে এআই-এর প্রভাব এবং কর্মীদের দক্ষতা কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের এই অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশও শিক্ষা নিতে পারে। আমাদের দেশেও শিল্পখাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা বাড়ছে। তাই, শ্রমিকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়তা করা জরুরি।
সেই সঙ্গে, বিশ্ব অর্থনীতির পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, আমাদের নীতি নির্ধারণ করতে হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন