হলিউডের কুখ্যাত প্রযোজক হার্ভে উইনস্টিনের বহুল আলোচিত মামলার পুনর্র্বিচার শুরু হতে যাচ্ছে। ২০২০ সালে ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তাঁর সাজা বাতিল করা হয়েছিল।
নিউ ইয়র্কের আপিল আদালত রায় দিয়েছিল যে, মামলার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক নেই এমন নারীদের সাক্ষ্য বিচারের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে, যা ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে পারেনি।
এই মামলার পুনঃশুরুণি নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, যা #MeToo আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল। এই আন্দোলনের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে নারীদের সোচ্চার হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
পুনরায় বিচারের মুখোমুখি হওয়ায় উইনস্টিনের সামনে এখন নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে। অন্যদিকে, অভিযোগকারীদের জন্য পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ বর্তমানে আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনেক বদলে গেছে।
মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী গ্লোরিয়া অলরেড সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “এই ট্রমার মধ্যে দিয়ে আবার যাওয়াটা খুবই কষ্টের।” তিনি আরও জানান, তিনজন নারীর সাক্ষ্য এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
তাঁদের মধ্যে একজন হলেন মিমি হ্যালি। তিনি ২০০০-এর দশকের শুরুতে উইনস্টিনের একটি টিভি শোতে কাজ করতেন। প্রথম বিচারের মতো এবারও তিনি উইনস্টিনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন।
তাঁর এবং সাবেক অভিনেত্রী জেসিকা ম্যানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই উইনস্টিনকে দোষী সাব্যস্ত করে ২৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, যা পরে বাতিল করা হয়। বিচারের দাবিতে এই দুই নারী আবারও সাক্ষ্য দিতে রাজি হয়েছেন।
আর্টের অ্যাটর্নি অলরেড তাঁর মক্কেল সম্পর্কে বলেন, “আমি তাঁর সাহসের প্রশংসা করি।”
পুনরায় বিচারে প্রসিকিউটররা নতুন একজন অভিযোগকারীকে যুক্ত করেছেন। জানা যায়, গ্র্যান্ড জুরির মাধ্যমে উইনস্টিনের বিরুদ্ধে নতুন করে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আনা হয়েছে।
নতুন সাক্ষী হলেন ‘জেন ডো’। তিনি অভিযোগ করেছেন, ২০০৬ সালে ম্যানহাটনের একটি হোটেলে উইনস্টিন তাঁর ওপর হামলা করেন।
জেন ডোর আইনজীবী লিন্ডসে গোল্ডব্রাম সিএনএনকে বলেন, “আপনি কল্পনা করতে পারেন, হার্ভে উইনস্টিনের মতো ক্ষমতাধর ব্যক্তির বিরুদ্ধে কেউ যখন সাক্ষ্য দিতে যাচ্ছেন, তখন তিনি কতটা নার্ভাস থাকবেন।
তাঁর মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করবে। তিনি তাঁর সাক্ষ্যের জন্য প্রস্তুত। আমি তাঁকে বিশ্বাস করি, প্রসিকিউটরও তাঁকে বিশ্বাস করেন এবং আমি মনে করি জুরিও তা-ই করবেন।”
পুনরায় বিচারে তিনজন অভিযোগকারীর ওপর বেশি মনোযোগ দেওয়া হবে। প্রথম বিচারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ছয়জন নারী।
আইনজীবী অলরেড বলেন, “আমার মনে হয়, আগের রায় বাতিল হওয়ায় অনেকেই হতবাক হয়েছিলেন।” তিনি আরও যোগ করেন, সহায়ক সাক্ষীদের সাক্ষ্য বাদ দেওয়ার আদালতের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত নন।
তিনি #MeToo আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত নারীদের ‘হিরো’ হিসেবে বর্ণনা করেন।
উইনস্টিনের আইনজীবীরা যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, প্রথম বিচারের আগে #MeToo আন্দোলন নিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের কারণে জুরিদের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা তৈরি হয়েছিল।
উইনস্টিনের প্রধান আইনজীবী আর্থার এইডা সিএনএনকে বলেন, “এখন দেশের এবং বিশ্বের অগ্রাধিকারগুলো ভিন্ন। আমার মনে হয়, এর ফলে উইনস্টিন একজন নিরপেক্ষ বিচারকের কাছ থেকে একটি সুষ্ঠু বিচার পাওয়ার ভালো সুযোগ পাবেন।”
আগের বিচার মিডিয়া কভারেজের দিক থেকে বেশ আলোচিত ছিল। উইনস্টিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে এবং #MeToo আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে নিয়মিতভাবে ম্যানহাটনের আদালতের বাইরে বিক্ষোভ হয়েছে।
এইডা আরও বলেন, “জুরিদের ওপর তাঁকে কোনো কিছুর জন্য দোষী সাব্যস্ত করার জন্য প্রচণ্ড চাপ ছিল।”
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, “আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণ শোনার সময় জুরিরা যেন তাঁদের মন খোলা রাখেন এবং অন্য কোথাও যা পড়েছেন বা দেখেছেন, সেগুলোর দ্বারা প্রভাবিত না হন।”
উইনস্টিনের আইনজীবীরা বলছেন, সমাজের চাপ এবং প্রচারণার কারণে উইনস্টিনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, প্রমাণের ভিত্তিতে নয়। তবে তিনজন নারী সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, উইনস্টিন তাঁদের যৌন নির্যাতন করেছেন।
১০০ জনের বেশি নারী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনেছেন।
উইনস্টিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন এবং তিনি কখনোই কাউকে ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতন করেননি বলে জানিয়েছেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি পৃথক মামলায় যৌন নিপীড়নের তিনটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর তিনি ২০১৬ বছর মেয়াদে কারাদণ্ড ভোগ করছেন। বর্তমানে তিনি নিউ ইয়র্কের রাইকার্স আইল্যান্ড কারাগারে বন্দী আছেন।
উইনস্টিনের আইনজীবীদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৭৩ বছর বয়সী উইনস্টিনের গত বছর হার্ট সার্জারি হয়েছে এবং কারাগারে তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
উইনস্টিনের মুখপাত্র জুডা এঙ্গেলমায়ার সিএনএনকে বলেন, “হার্ভে উইনস্টিনের স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতি হচ্ছে এবং রাইকার্সের পরিস্থিতি এর জন্য সরাসরি দায়ী।” তিনি আরও জানান, উইনস্টিনের ডায়াবেটিস, জিহ্বায় প্রদাহ, চলাফেরায় সমস্যা এবং হৃদরোগ রয়েছে।
উইনস্টিনের আগের মামলার রায় বাতিলের পর সিএনএনের সঙ্গে কথা বলার সময় কয়েকজন অভিযোগকারী জানিয়েছেন, তাঁরা আশঙ্কা করছেন যে, উইনস্টিন হয়তো আপিল জিততে পারেন।
উইনস্টিনের প্রথম বিচারের সময় প্রসিকিউশনের পক্ষে সাক্ষ্য দেওয়া ডন ডানিং সিএনএনকে বলেন, “যদি তিনি আবার মুক্তি পান, তাহলে এটা খুবই ভয়ের হবে।”
আইনজীবী অলরেড বলেন, এই বিচারের ফল যা-ই হোক না কেন, গত এক দশকে কর্মক্ষেত্রে এবং বিচার ব্যবস্থায় নারীদের যে অগ্রগতি হয়েছে, তা উইনস্টিনের বিচারের ফল।
তিনি আরও যোগ করেন, “এই মামলায় যা-ই ঘটুক না কেন, নারীরা তাঁদের অধিকারের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবেন।”
তথ্য সূত্র: সিএনএন