পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণের পর নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া: যা জানা দরকার।
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের প্রয়াণের পর এখন বিশ্বজুড়ে এই ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। একইসঙ্গে শুরু হয়েছে নতুন পোপ নির্বাচনের প্রক্রিয়া।
এই নির্বাচন একটি দীর্ঘ এবং ঐতিহ্যপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসছে। তবে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা কার্ডিনালদের একটি বিশেষ সম্মেলনে মিলিত হতে হয়, যা ‘কনক্লেভ’ নামে পরিচিত। সাধারণত, নতুন পোপ নির্বাচিত হতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময় লাগে।
তবে কার্ডিনালরা যদি কোনো প্রার্থীর বিষয়ে একমত হতে না পারেন, সেক্ষেত্রে এই সময় আরও বাড়তে পারে।
নির্বাচন প্রক্রিয়াটি গোপনীয়তার সঙ্গে সম্পন্ন হয়, তবে সারা বিশ্বের মানুষ এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্যাথলিক চার্চের ভাবমূর্তি বর্তমানে কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বিশেষ করে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগের কারণে।
তাই নতুন পোপের নির্বাচন এই চার্চের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পোপের মৃত্যুর পর শোকের সময় কী হয়?
পোপের মৃত্যুর পর ‘পাপাল ইন্টাররেগ্নাম’ শুরু হয়। এটি হলো এক পোপের মৃত্যুর পর নতুন পোপ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত সময়কাল।
এই সময়ে কার্ডিনালরা শোক পালন করেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিনক্ষণ ঠিক করেন। প্রথা অনুযায়ী, পোপের মৃত্যুর চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ দিনের মধ্যে তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়।
পোপের মরদেহ সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকায় রাখা হয়, যেখানে শোকাহত মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন। এর আগে, পোপ দ্বিতীয় জন পলের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন।
শোকের সময়টিতে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতাও পালন করা হয়। প্রয়াত পোপের জন্মস্থান বুয়েনস আইরেসে এবং পোল্যান্ডের ওয়ারশ-তে বিশেষ প্রার্থনাসভার আয়োজন করা হতে পারে।
এরপর সেন্ট পিটার্স-এ একটি বিশাল অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা উপস্থিত হন। পোপ দ্বিতীয় জন পলের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ এবং তাঁর পূর্বসূরি বিল ক্লিনটন ও জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ-ও যোগ দিয়েছিলেন।
নতুন পোপ নির্বাচন কবে শুরু হবে?
পোপের মৃত্যুর পর কার্ডিনালদের সভা আহ্বান করা হয়, যেখানে ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা ভোট দিতে পারেন। বর্তমানে এই ধরনের কার্ডিনালের সংখ্যা ১৩৬ জন।
তবে, ১৯৯৬ সালে পোপ দ্বিতীয় জন পল নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন এমন কার্ডিনালের সংখ্যা ১২০ জনে সীমিত করেছিলেন।
সাধারণত, পোপের মৃত্যুর ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে কনক্লেভ শুরু হওয়ার কথা। তবে কার্ডিনালরা দ্রুত এসে পৌঁছালে, আলোচনা করে এই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত শুরু করা যেতে পারে।
কনক্লেভ-এর গোপনীয়তা রক্ষার জন্য সিস্টিন চ্যাপেলে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক কার্ডিনালকে একটি ব্যালট পেপার দেওয়া হয়, যেখানে তাঁরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর নাম লেখেন।
এরপর তাঁরা “ইলিগো ইন সাম্মুম পন্টিফেক্স” (আমি সর্বোচ্চ পোপ নির্বাচন করছি) -এর নিচে তাঁদের ব্যালট জমা দেন।
প্রকৃতপক্ষে, যে কোনো ক্যাথলিক পুরুষই পোপ নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। তবে ১৩৭৯ সালের পর থেকে কার্ডিনাল কলেজের বাইরের কাউকে পোপ হিসেবে নির্বাচিত করা হয়নি।
ভোট গণনা শেষে ফলাফল কার্ডিনালদের কাছে পাঠ করা হয়। যদি কোনো প্রার্থী দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পান, তাহলে তিনিই নতুন পোপ নির্বাচিত হন।
কনক্লেভে দিনে সর্বোচ্চ চারবার ভোট হতে পারে – সকালে দু’বার এবং বিকেলে দু’বার। এরপর আলোচনার জন্য একদিন বিরতি দেওয়া হয় এবং আবার ভোট গ্রহণ শুরু হয়।
পোপ নির্বাচিত হলে কী হয়?
নতুন পোপ নির্বাচনের খবর নিশ্চিত করার জন্য ভ্যাটিকানের ছাদে একটি বিশেষ চিমনি ব্যবহার করা হয়। ভোটের পর ব্যালটগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
যদি কোনো পোপ নির্বাচিত না হন, তাহলে কালো ধোঁয়া নির্গত হয়।
অন্যদিকে, যদি সাদা ধোঁয়া বের হয়, তাহলে এর অর্থ হলো নতুন পোপ নির্বাচিত হয়েছেন এবং ‘সিদে ভ্যাকান্তে’ (চেয়ার শূন্য) অবস্থার অবসান হয়েছে।
সাধারণত, সাদা ধোঁয়া দেখা যাওয়ার ৩০ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে নতুন পোপ সেন্ট পিটার্স স্কয়ারের বারান্দায় আসেন।
সেখানে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয় এবং তিনি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন ও প্রার্থনা করেন। নির্বাচনের কয়েক দিন পর তাঁর আনুষ্ঠানিক অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়।
নতুন পোপের গুরুত্ব
ক্যাথলিক চার্চের প্রধান হিসেবে পোপের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বিশ্বের প্রায় ১৩০ কোটি ক্যাথলিক ধর্মাবলম্বীর কাছে তিনি আধ্যাত্মিক নেতা।
নতুন পোপের নীতি, বিশ্বাস এবং কর্মপন্থা চার্চের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।
পোপ ফ্রান্সিস তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গির জন্য পরিচিত ছিলেন। তাঁর সময়ে সমকামিতা এবং মৃত্যুদণ্ডের মতো বিষয়ে আগের পোপদের চেয়ে ভিন্নমত পোষণ করা হয়েছে।
এখন দেখার বিষয়, নতুন পোপ সেই পথে চলবেন নাকি বাইবেলের কঠোর ব্যাখ্যা অনুসরণ করবেন।
এছাড়াও, শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে নতুন পোপের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে যারা এ ধরনের অভিযোগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পদক্ষেপ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হবে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন