প্রাচীন কালের এক বিশাল বন্যা, যা ভূ-পৃষ্ঠের ইতিহাসে বৃহত্তম, কেমন করে সৃষ্টি করেছিল ভূমধ্যসাগর? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য।
আজ থেকে প্রায় ৫৩ লক্ষ বছর আগে, এই অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতির এক বিরাট পরিবর্তন ঘটেছিল, যা ‘জান্ক্লিয়ান মেগাফ্লাড’ নামে পরিচিত।
ভূমধ্যসাগরের বর্তমান চিত্র তখনকার থেকে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। টেকটনিক প্লেটের কারণে জিব্রাল্টার প্রণালীতে একটি পর্বতমালা তৈরি হয়, যা আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
ফলে, সূর্যের তাপে সাগর শুকিয়ে যেতে শুরু করে এবং সেখানে লবণাক্ত হ্রদের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীরা এই ঘটনাকে ‘মেসিনিয়ান স্যালিনিটি ক্রাইসিস’ নামে অভিহিত করেছেন।
কিন্তু এরপরই ঘটে এক বিশাল পরিবর্তন। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ৫৩ লক্ষ বছর আগে আটলান্টিক মহাসাগরের জল ধীরে ধীরে সেই পর্বতমালা অতিক্রম করতে শুরু করে।
প্রথমে সামান্য জলধারা, যা পরে একটি স্রোতে পরিণত হয় এবং অবশেষে এক ভয়ংকর বন্যায় পরিণত হয়। আটলান্টিক মহাসাগরের জল প্রবল বেগে ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে শুরু করে।
এই বন্যার বেগ এতটাই বেশি ছিল যে আধুনিক দিনের সিসিলি উপকূলের কাছাকাছি এটি ঘন্টায় প্রায় ৭২ মাইল বেগে আঘাত হানে।
এই জলস্রোতের কারণে সৃষ্টি হয় শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়, যা সেই অঞ্চলের পরিবেশকে সম্পূর্ণ বদলে দেয়। বন্যার পানিতে আটকা পড়ে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী মারা যায়।
কয়েক বছরের মধ্যে, ভূমধ্যসাগরে জলের স্তর বাড়তে থাকে, যার ফলে ভূমিকম্প হয় এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বন্যা এতটাই শক্তিশালী ছিল যে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৬৮ থেকে ১০০ মিলিয়ন ঘনমিটার জল প্রবাহিত হয়েছিল।
এই ঘটনার ফলস্বরূপ, ভূমধ্যসাগরের পশ্চিমাংশ দ্রুত জলপূর্ণ হতে শুরু করে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই বিশাল জলরাশি মাল্টা এসকার্পমেন্ট নামক একটি স্থানে বাধা পায় এবং এর ফলে বিশাল জলপ্রপাতের সৃষ্টি হয়, যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম জলপ্রপাতগুলির মধ্যে একটি।
অবশেষে, কয়েক বছর পর, ভূমধ্যসাগর আটলান্টিক মহাসাগরের সঙ্গে পুনরায় মিলিত হয় এবং ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।
এই ঘটনার ওপর গবেষণা করেছেন মন্টারে বে অ্যাকোয়ারিয়াম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সমুদ্রবিজ্ঞানী অ্যারন মিক্যালেফ। তাঁর মতে, এই ধরনের ঘটনা ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও ঘটতে পারে।
তাই, এই মেগাফ্লাড অধ্যয়নের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুতি নিতে পারবেন।
ইউনিভার্সিটি অফ ভিয়েনার ভূতত্ত্ববিদ কনস্টান্টিনা অ্যাগিয়াদি মনে করেন, একবার কোনো অঞ্চলের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তা আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা কঠিন।
ভূমধ্যসাগরের ক্ষেত্রেও তেমনটাই হয়েছে। এই বন্যার ফলে সেখানকার জীববৈচিত্র্যে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে এবং অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের দেশেও যে বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি বাড়ছে, এই ঘটনাটি যেন তারই একটি প্রতিচ্ছবি।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক।