যুদ্ধবিধ্বস্ত ইয়েমেনে একটানা বিমান হামলার শিকার হওয়া সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কতটা কঠিন হয়ে পড়েছে, সেই হৃদয়বিদারক চিত্র তুলে ধরেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইয়েমেনি। এপ্রিল মাসের শুরুতে, তার পরিবারের কাছাকাছি একটি আবাসিক এলাকায় মার্কিন বিমান হামলা চালানো হয়।
বোমা বিস্ফোরণের শব্দ, ঘর কাঁপানো, শিশুদের আর্তচিৎকার—যেন এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা। বিগত দশ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে, এখন তাদের কাছে মনে হচ্ছে যেন তারা নতুন একটি স্তরে প্রবেশ করেছে, যেখানে আরও ভয়ঙ্কর এক দানবের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
আঘাত হয়তো মানুষকে ভয় জয় করতে শেখায়, এমনটাই ধারণা ছিল লেখকের। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা ভিন্ন। বোমা হামলায় তার ছয় বছর বয়সী ছেলে তামিমের চোখে-মুখে ছিল গভীর আতঙ্ক।
ছেলেটির কাছে যুদ্ধটা এখনো সেভাবে স্পষ্ট নয়। সে জানতে চায়, “এটা কি ভূমিকম্প?”
ছেলেকে শান্ত করতে তিনি মিথ্যা বলেন, “না, এটা ভূমিকম্প নয়, বিমান উড়ে যাওয়ার সময় ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে।” বিমানের প্রতি তামিমের ভালোবাসা নষ্ট করতে চাননি তিনি। কারণ, বিমানের আকাশে ওড়ার স্বপ্ন তার অনেক দিনের।
তবে, এই ঘটনার পর লেখকের মনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়। কারণ, তিনি জানেন, একদিন তার ছেলে ঠিকই বুঝবে, বিমানের শব্দ আসলে তাদের জন্য কী বার্তা বয়ে আনে।
পরে জানা যায়, হামলার লক্ষ্য ছিল একটি বাড়ির পাশের একটি স্থাপনা। সেই বাড়িটি ছিল তার এক বন্ধুর বোনের। তিনি দ্রুত বন্ধুকে ফোন করেন এবং দুঃসংবাদটি জানান। হামলায় নিহত হয় বন্ধুর ১৮ বছর বয়সী ভাগ্নে, মোহাম্মদ।
ভালো ফলাফলের মাধ্যমে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করার স্বপ্ন দেখত সে।
এর কয়েক সপ্তাহ পরেই, রাস ইসা বন্দরে বোমা হামলায় ৮০ জন নিহত হয়। তাদের মধ্যে ছিলেন ২৬ বছর বয়সী আব্দুল ফাত্তাহ। তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ইয়েমেনিদের জীবনে শোক যেন নিত্যদিনের সঙ্গী। প্রিয়জনের মরদেহ খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণা পরিবারগুলোর কাছে সবচেয়ে কঠিন এক বাস্তবতা।
যুদ্ধ আর ধ্বংসের মাঝেও ইয়েমেনিরা তাদের মানবিকতা ও সহানুভূতির পরিচয় দেয়। অনেকেই বলেন, তাদের এই কষ্ট গাজার পরিস্থিতির চেয়ে কম। যেন তারা তাদের কষ্টকে অন্য কারো সঙ্গে তুলনা করতে চায়, যেন তাদের দুঃখের স্বীকৃতি অন্য একটি কষ্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়।
লেখক প্রশ্ন করেন, তারা কি সবাই গভীর হতাশায় ভুগছেন? নাকি এই ভয়াবহতার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কোনো অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা তাদের আছে?
বিমান হামলা বাড়ুক বা কমুক, তাদের হৃদয়ের শান্তি নেই। এই শোক তাদের শরীরে জমা হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভীত করে তোলে।
বিশ্ব যেন তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন আর সংবাদে তারা কেবল সংখ্যায় পরিণত হয়েছে।
লেখক মনে করেন, লেখার মাধ্যমে হয়তো মোহাম্মদ, আব্দুল ফাত্তাহ এবং আরও হাজারো ইয়েমেনির স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখা যেতে পারে। হয়তো একদিন তাদের লেখালেখি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত থামাতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা