চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে চলমান তীব্র অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব বিশ্বজুড়ে নতুন মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন এই দুই পরাশক্তির মধ্যে নিজেদের অবস্থান বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে।
অন্যদিকে যেমন বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রও তার মিত্রদের পাশে চাইছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য এই পরিস্থিতি কেমন হতে পারে, তাই নিয়েই আজকের আলোচনা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ এখন একটি পরিচিত ঘটনা। মার্কিন সরকার চীনের ওপর শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যেকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও কঠিন হয়ে উঠেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা ব্যবস্থা নিচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অনেক দেশই এখন উভয় সংকটে পড়েছে। তারা একদিকে যেমন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, তেমনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতেও রাজি নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে সুইজারল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট যখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা করতে ওয়াশিংটনে যান, তখন তাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বেইজিংয়ে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও জোরদার করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এটি ছিল সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেত।
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওং-এর মতে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই চাইছে অন্যান্য দেশ তাদের দিকে ঝুঁকুক, যদিও তারা সরাসরি কাউকে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য করতে চাইছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতির কারণে অনেক দেশ এখন চীনের দিকে ঝুঁকছে। চীন নিজেকে একটি স্থিতিশীল এবং নির্ভরযোগ্য বাণিজ্য সহযোগী হিসেবে তুলে ধরছে।
এর মূল কারণ হলো, তারা যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের প্রভাব থেকে বাঁচতে চাইছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের বাইরেও শক্তিশালী বাণিজ্য সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী।
যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিভিন্ন পণ্যের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেছে, যা ইতোমধ্যে দেশটির আমদানিকে প্রভাবিত করছে। এর ফলে লস অ্যাঞ্জেলেস বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজের আগমন প্রায় ৩৬ শতাংশ কমে গেছে।
এমন পরিস্থিতিতে উভয় দেশই বিকল্প বাণিজ্য অংশীদারদের সমর্থন চাইছে।
তবে, এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের বিষয় হলো, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার এই বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে আমাদের বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে, তৈরি পোশাকের মতো রপ্তানি খাতে এর প্রভাব পড়তে পারে।
কারণ, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একটি বড় বাজার। অন্যদিকে, চীন থেকেও আমরা বিভিন্ন পণ্য আমদানি করি।
চীন এখন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানিকারক এবং যুক্তরাষ্ট্র বৃহত্তম আমদানিকারক দেশ। গত বছর চীনের মোট বাণিজ্য ছিল প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
চীন বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সঙ্গেই বৃহত্তম বাণিজ্য সহযোগী, যার মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আসিয়ানের দেশগুলো অন্যতম।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ রপ্তানি গন্তব্য। তবে, চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশের উচিত হবে বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও বহুমুখী করা। অর্থাৎ, একদিকে যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখা, তেমনই অন্যান্য দেশের সঙ্গেও বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ উভয় পরাশক্তির সঙ্গেই অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত থাকতে চায়। তাই, এই পরিস্থিতিতে আমাদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং দেশের স্বার্থকে সবার উপরে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সম্প্রতি ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়া সফর করেছেন এবং তাদের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের সম্মুখীন হচ্ছে।
চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কোনো দেশ যেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এমন কোনো চুক্তি না করে, যা চীনের স্বার্থের পরিপন্থী। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে চীন পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের এই বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতিতে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে এবং দেশের অর্থনীতির সুরক্ষায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস