যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বিশ্বে বাড়ছে সামরিক ব্যয়: ইউরোপের নেতৃত্বে রেকর্ড বৃদ্ধি
গত বছর বিশ্বজুড়ে সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়েছে, যা স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সর্বোচ্চ।
স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট (SIPRI)-এর এক প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সামরিক ব্যয়ের এই বৃদ্ধিতে নেতৃত্ব দিয়েছে ইউরোপ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউরোপের দেশগুলো তাদের সামরিক খাতে ব্যয় ১৭ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে।
এর ফলে তাদের সম্মিলিত সামরিক বাজেট দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬৯৩ বিলিয়ন ডলারে। একই সময়ে, বিশ্বব্যাপী সামরিক ব্যয় ৯.৪ শতাংশ বেড়ে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো ইউক্রেন যুদ্ধ এবং সেই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ।
বিশেষ করে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা কমিয়ে দেয়, সেক্ষেত্রে ইউরোপের দেশগুলোর ওপর নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্ব আরও বেশি বর্তাবে।
ব্রুকলিং ইনস্টিটিউটের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা বন্ধ হয়ে গেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তাদের জিডিপির মাত্র ০.১২ শতাংশ বেশি খরচ করতে হবে।
যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সামরিক ব্যয় করতে হচ্ছে রাশিয়াকে।
গত বছর দেশটি তাদের সামরিক খাতে ব্যয় ৩৮ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে, যা যেকোনো দেশের তুলনায় সর্বোচ্চ।
ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কারণে রাশিয়াকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে।
তাদের সামরিক ব্যয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৯ বিলিয়ন ডলারে, যা দেশটির মোট অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৭ শতাংশের বেশি।
অন্যদিকে, ইউক্রেন তাদের প্রতিরক্ষা খাতে ৬৪.৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে, যা তাদের মোট রাজস্ব আয়ের সমান এবং দেশটির জিডিপির ৩৪ শতাংশ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশেই এখন সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।
জার্মানি এরই মধ্যে একটি বিশাল তহবিল তৈরি করেছে, যার পরিমাণ প্রায় ১১৩.৫ বিলিয়ন ডলার।
এছাড়া, গ্রিসসহ অন্যান্য দেশগুলোও তাদের সামরিক খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বাড়াচ্ছে।
সামরিক ব্যয়ের এই বৃদ্ধিকে কেউ কেউ ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
তাদের মতে, এর মাধ্যমে ইউরোপীয় দেশগুলো নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়াতে পারবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীলতা কমবে।
তবে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কিভাবে ব্যয় করা হচ্ছে, তা নিয়ে কিছু উদ্বেগ রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু অর্থ খরচ করলেই সামরিক সক্ষমতা বাড়ে না।
আধুনিক সামরিক বাহিনী গড়তে সময় লাগে।
জনবল তৈরি, সরঞ্জাম কেনা, এবং তাদের প্রশিক্ষণ দিতে দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, জার্মানি ইতিমধ্যে লিথুয়ানিয়াকে একটি ব্রিগেড দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু সেটি প্রস্তুত হতে ২০২৭ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে।
সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি, এই অর্থ কিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই বিষয়েও নজর রাখা দরকার।
অনেক সময় দেখা যায়, উন্নত সামরিক সরঞ্জাম কেনার পরিবর্তে অপ্রয়োজনীয় খাতে অর্থ খরচ করা হচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সামরিক খাতে সমন্বয় আনা প্রয়োজন।
বিভিন্ন দেশের নিজস্ব অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি তৈরির প্রতিযোগিতার বদলে, একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করা গেলে তা আরও কার্যকর হবে।
তবে, কেউ কেউ এই ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তাদের মতে, বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করলেও যুদ্ধের গতি হয়তো সেভাবে বাড়বে না।
বরং এতে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ বাড়বে।
সব মিলিয়ে, বিশ্বজুড়ে সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির এই প্রবণতা একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এর ফলে একদিকে যেমন দেশগুলো নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করতে চাইছে, তেমনি যুদ্ধের ভয়াবহতা আরও বাড়ছে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা