কাশ্মীর পরিস্থিতি: সিমলা চুক্তি বাতিলের হুমকি, ভারত-পাকিস্তানের সম্পর্কে নতুন সংকট?
গত ২২শে এপ্রিল, ভারতীয়-শাসিত কাশ্মীরের পাহালগামে পর্যটকদের উপর সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চরম আকার ধারণ করেছে। দুই দেশই পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে, যা বৃহত্তর সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে সিমলা চুক্তি বাতিল করার হুমকি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
পাহালগামের ঘটনার পর, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এক মন্ত্রিসভার বৈঠকে, দুই দেশের মধ্যেকার গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি – সিন্ধু জল চুক্তি (Indus Waters Treaty – IWT) স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে সিন্ধু নদীর জল ব্যবহারের বিষয়ে নীতি নির্ধারিত হয়। এছাড়াও, ভারত পাকিস্তান সীমান্ত বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত করা, ভিসা বাতিল এবং ভারতে নিযুক্ত পাকিস্তানি কূটনীতিকদের সংখ্যা কমানোর মতো পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে।
পাল্টা জবাবে, পাকিস্তানের শীর্ষ সামরিক-বেসামরিক নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় নিরাপত্তা কমিটি (National Security Committee – NSC) সীমান্ত ও আকাশপথ বন্ধ করা, বাণিজ্য স্থগিত করা এবং সিমলা চুক্তি সহ ভারতের সঙ্গে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বাতিলের হুমকি দিয়েছে।
১৯৭২ সালে স্বাক্ষরিত সিমলা চুক্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
এই চুক্তির মূল বিষয়গুলি হলো – নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control – LoC) নির্ধারণ এবং কাশ্মীর সহ বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয় শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা। এখন, পাকিস্তানের এমন সিদ্ধান্তে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
যদি পাকিস্তান চুক্তিটি বাতিল করে, তবে এর ফল মারাত্মক হতে পারে।
সিমলা চুক্তি কী?
১৯৭১ সালের যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের পর, পাকিস্তানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, হিমাচল প্রদেশের রাজধানী শিমলায় মিলিত হয়ে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন।
এই বৈঠকের ফলস্বরূপ, ২রা জুলাই, ১৯৭২ তারিখে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
এই চুক্তির মূল বিষয়গুলি ছিল – দ্বিপাক্ষিকভাবে বিবাদ নিষ্পত্তি, কাশ্মীর সমস্যার সমাধান এবং উভয় দেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান বজায় রাখা।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যুদ্ধবিরতি রেখার (Ceasefire Line) নামকরণ পরিবর্তন করে নিয়ন্ত্রণ রেখা (Line of Control – LoC) করা হয়। উভয় পক্ষই একতরফাভাবে এই রেখা পরিবর্তন করতে পারবে না বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ও পাকিস্তানের প্রাক্তন উপদেষ্টা, আহমার বিল্লাহ সুফি, সিমলা চুক্তিকে দুই দেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
তিনি মনে করেন, চুক্তি স্থগিত করার আগে পাকিস্তানের উচিত হবে দেশের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি বিস্তারিত অভ্যন্তরীণ পর্যালোচনা করা।
অন্য একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ, মুহাম্মদ মুশতাক আহমদ মনে করেন, ভারত দীর্ঘদিন ধরে সিমলা চুক্তিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের (United Nations Security Council – UNSC) প্রস্তাবের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছে।
ভারতের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীর ইস্যু দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তা দূর করে দিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই চুক্তির বাতিলের ফলে নিয়ন্ত্রণ রেখায় (LoC) উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
এর ফলে, দুই দেশই অস্ত্র ব্যবহারের দিকে ঝুঁকতে পারে, কারণ তখন কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি তাদের শান্ত থাকতে বাধ্য করবে না।
পাকিস্তানের যুক্তি
পাকিস্তানের মতে, ভারত সিমলা চুক্তির অপব্যবহার করেছে।
তাদের অভিযোগ, ভারত কাশ্মীরকে একটি দ্বিপাক্ষিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করে আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপকে বাধা দিচ্ছে।
তাই, চুক্তি বাতিল করে তারা কাশ্মীর ইস্যুকে পুনরায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপন করতে চাইছে।
অন্যদিকে, ভারতের আশঙ্কা
ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, উভয় দেশই মনে করে চুক্তিটি তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে না।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করার ভারতের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে আগ্রাসন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যা পাকিস্তানের আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন করে।
উপসংহার
সিমলা চুক্তি বাতিলের পাকিস্তানের হুমকি ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়।
এটি কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকে আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে, উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হচ্ছে, যাতে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে না যায়।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা