ফিলিস্তিনে একটি সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি: আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ।
গত কয়েক সপ্তাহে গাজা ও পশ্চিম তীরে একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের দাবি জোরালো হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর্মী, চিকিৎসা বিষয়ক সংস্থা, ফিলিস্তিনি এনজিও এবং সাধারণ আরব নাগরিকরাও এই দাবি জানাচ্ছেন।
এমনকি, মানবাধিকার সংস্থা ও আরব লিগও গত বছর গাজায় শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছিল।
বর্তমান বিশ্বে, গণহত্যার মতো ঘটনাগুলো সরাসরি সম্প্রচারিত হচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অনীহা দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে, ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য এই সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা অত্যন্ত জরুরি।
আন্তর্জাতিক আদালতের তদন্ত এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে গণহত্যার শিকার হওয়া ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য এই বাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
গাজা ও পশ্চিম তীরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং আন্তর্জাতিক আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, এই ধরনের বাহিনী মোতায়েন করা হলে তা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের দখলদারিত্ব অবসানে সহায়তা করতে পারে।
কিন্তু একটি সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা সহজ নয়। এর প্রধান কারণ হলো, এই ব্যাপারে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, এই চ্যালেঞ্জগুলো কি অতিক্রম করা সম্ভব?
গাজা ও পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি বর্তমানে চরম আকার ধারণ করেছে। লেবানন ও ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনিদের রক্ষার জন্য সামরিক চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করলেও, তারা নৃশংসতা বন্ধ করতে পারেনি।
বরং, লেবানন ও ইয়েমেনের মানুষ এর চরম মূল্য দিয়েছে।
এ কারণেই, একটি আন্তর্জাতিক সুরক্ষা বাহিনীর জরুরি প্রয়োজন।
এই বাহিনী মোতায়েন করা হলে, ফিলিস্তিনি জনগণের একটি প্রধান দাবি পূরণ হবে: তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
এটি “মানব ঢাল”-এর মতো কাজ করবে, তবে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর ব্যবহারের মতো নিন্দনীয় অর্থে নয়।
বরং, এটি ফিলিস্তিনি এবং তাদের ধ্বংসের মধ্যে একটি শান্তিপূর্ণ বাধা হিসেবে কাজ করবে।
এই বাহিনীর উপস্থিতি, গত দেড় বছর ধরে বোমাবর্ষণ, অবরোধ ও খাদ্য সংকটে জর্জরিত ফিলিস্তিনিদের জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
এছাড়াও, এই বাহিনী আরও খারাপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ইসরায়েল যখন ফিলিস্তিনিদের জীবন ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তাদের ওপর নিপীড়ন চালাচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্র গাজায় সেনা মোতায়েন করে “নিয়ন্ত্রণ” নেওয়ার চিন্তা করছে।
এমন পদক্ষেপ হবে ফিলিস্তিনের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অবৈধ আগ্রাসন, যা “স্থিতিশীলতা” রক্ষার নামে ঔপনিবেশিক সহিংসতাকে আরও বাড়াবে।
এর বিপরীতে, ফিলিস্তিনিদের রক্ষার দায়িত্বে থাকা একটি বাহিনী, সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক স্বার্থের পরিবর্তে, আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত একটি বৈধ ব্যবস্থা সরবরাহ করতে পারে।
জাতিসংঘের মাধ্যমে সুরক্ষা বাহিনী মোতায়েনের জন্য নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত এই ধরনের পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে, যেমনটা তারা বিভিন্ন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ক্ষেত্রে করেছে।
এর ফলে, গণহত্যা বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ তৈরি হবে এবং জাতিসংঘের সনদের মৌলিক নীতিগুলো রক্ষার যেকোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে।
যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়ন ও উচ্ছেদের সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানাচ্ছে।
এমতাবস্থায়, পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।
এমনকি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও গাজা উপত্যকাকে “ধ্বংসস্তূপ” হিসেবে বর্ণনা করেছেন এবং এটিকে “মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা” বানানোর ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।
যেহেতু নিরাপত্তা পরিষদে সুরক্ষা বাহিনীর প্রস্তাব আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তাই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
সেখানেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিদ্যমান, তবে এটি এখনো একটি কার্যকর বিকল্প হতে পারে।
আগামী মে মাসে সাধারণ পরিষদের পরবর্তী অধিবেশনে এই বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
এর জন্য ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন।
সাধারণ পরিষদে সুরক্ষা বাহিনীর পক্ষে ভোট হলে তা বাধ্যতামূলক হবে না এবং নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে।
তবে, এটি এমন দেশগুলোর মধ্যে একটি জোট তৈরি করতে পারে, যারা ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্ষার জন্য বাস্তব পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
তবে, শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই ধরনের পদক্ষেপের বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে।
কারণ, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রায়ই উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
ঐতিহাসিকভাবে, শান্তিরক্ষা কার্যক্রম সাধারণত সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল এবং খুব কমই তাদের বিরোধিতা করেছে।
শান্তিরক্ষী বাহিনীতে সৈন্য সরবরাহকারী দেশগুলোর মধ্যে প্রায়ই বিতর্কিত সামরিক জোট থাকে এবং এই কার্যক্রম যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় দাতাদের অর্থায়নের ওপর নির্ভরশীল।
এর একটি উদাহরণ হলো লেবাননে জাতিসংঘের অন্তর্বর্তীকালীন বাহিনী (ইউএনআইএফআইএল)।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি সুরক্ষা বাহিনীর দাবি কি বাতিল করা হবে?
অবশ্যই না।
এখানে প্রতিবন্ধকতাগুলো বাস্তব, তবে সুরক্ষা বাহিনীর দাবি ন্যায্য।
এটি ফিলিস্তিনি সমাজের বিভিন্ন অংশ থেকে এসেছে এবং গণহত্যা বিরোধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগুলো বিশ্বব্যাপী এর সমর্থন জুগিয়েছে।
সম্প্রতি, ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মীরা একটি মডেল প্রস্তাব করেছেন: একটি নিরপেক্ষ, বহুজাতিক সুরক্ষা মিশন, যা মধ্যস্থতা নয় বরং সুরক্ষার জন্য কাজ করবে।
তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, গণহত্যায় জড়িত দেশগুলোকে সেনা সরবরাহ থেকে বিরত রাখা এবং সুরক্ষা বাহিনীকে ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের রক্ষা করা, মানবিক ও চিকিৎসা করিডোর পুনরুদ্ধার করা এবং গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠনে সহায়তা করা।
একইভাবে, ফিলিস্তিনি এনজিও নেটওয়ার্ক আন্তর্জাতিক সুরক্ষা, গাজায় প্রবেশপথ খোলা এবং নিরাপদ সহায়তা করিডোর নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।
এমনকি, মিশরীয় নাগরিকরাও সীমান্ত খোলা হলে বেসামরিক সুরক্ষা বাহিনী হিসেবে গাজায় প্রবেশ করতে প্রস্তুত বলে ঘোষণা করেছেন।
এটি আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণে সুরক্ষার সম্ভাবনাকে তুলে ধরে।
এই আহ্বানগুলো বাস্তবায়নের জন্য, সুরক্ষা বাহিনীর ধারণা এবং কার্যকারিতা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
প্রথমত, আমাদের এমন দেশ ও সুশীল সমাজ গোষ্ঠী প্রয়োজন, যারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করবে।
তাদের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি বিশেষ অধিবেশনে (মে মাসে) যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে হবে এবং শান্তিরক্ষী মিশনের জন্য ভোটের ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের দক্ষিণ-দক্ষিণ জোট তৈরি করতে হবে।
এর অর্থ হলো, গণহত্যায় জড়িত নয় এমন উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে কৌশলগত অংশীদারিত্ব তৈরি করা, যা সাম্রাজ্যবাদী প্রভাবমুক্ত একটি মিশনের জন্য অর্থায়ন ও জনবল সরবরাহ করবে, এমনকি নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়াই এই মিশন চলতে পারবে।
তৃতীয়ত, একটি সত্যিকারের নিরপেক্ষ সুরক্ষা বাহিনী গঠনে সরকারগুলোকে সমর্থন ও অংশগ্রহণের জন্য সুশীল সমাজের নজিরবিহীন ঐক্য প্রয়োজন।
যুক্তরাষ্ট্র এমন কোনো নতুন জোটের বিরোধিতা করবে, যা ফিলিস্তিনিদের জীবনকে কেন্দ্র করে গঠিত হবে এবং নিজেদের সুরক্ষার দায়িত্বের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে উপস্থাপন করবে।
তারা এটিকে তাদের আধিপত্য এবং গণহত্যা বিরোধী আলোচনার ওপর পশ্চিমা একচেটিয়া আধিপত্যের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখবে এবং পরিষদের ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করবে।
তবে, সুরক্ষা বাহিনী গঠনে জড়িত দেশ ও সুশীল সমাজ গোষ্ঠীগুলোকে ভেটো উপেক্ষা করতে হবে, স্বাধীনভাবে মিশন গঠন করতে হবে এবং আমরা যে গণহত্যার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় বাস করছি, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
এই নতুন ধরনের প্রচেষ্টার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
কিন্তু এর বিকল্প হলো, ফিলিস্তিনিদের জীবনকে অরক্ষিত রাখা, যা একটি ক্রমবর্ধমান উপনিবেশিক নির্মূল প্রক্রিয়ার শিকার।
আমাদের এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনের জন্য একটি সুরক্ষা বাহিনীর দাবি জানাতে হবে।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা