চীনের ক্ষমতাসীন দলের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এক ব্যবসায়ীর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আলিবাবার সহ-প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মার সাহায্য চেয়েছিল চীনা কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি ফাঁস হওয়া কিছু নথি থেকে এমনটাই জানা গেছে।
জানা যায়, ফ্রান্সপ্রবাসী এক চীনা ব্যবসায়ীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে এবং ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে রাজি করানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। ওই ব্যবসায়ীর নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তার নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না, তাকে ‘এইচ’ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
অভিযোগ উঠেছে, চীনের পক্ষ থেকে এইচকে দেশে ফিরতে রাজি করানোর জন্য নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়। এর মধ্যে ছিল, তার বোনকে গ্রেপ্তার করা, ফোনে হুমকি দেওয়া এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রেড নোটিশ’ জারি করা।
২০২১ সালের এপ্রিল মাসে জ্যাক মা’র একটি ফোন কল ছিল এই ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ওই সময় জ্যাক মা এইচকে বলেন, “আপনাকে দেশে ফেরাতে পারার মতো ক্ষমতা আমারই আছে।”
এই কথোপকথন রেকর্ড করেছিলেন এইচ। এর আগে, তিনি চীনা নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সঙ্গে হওয়া কথোপকথনও রেকর্ড করেছিলেন, যেখানে একই বার্তা দেওয়া হয়েছিল।
ফ্রান্সের আদালতে পেশ করা এই অডিও রেকর্ড এবং অন্যান্য আইনি নথিগুলো বিশ্লেষণ করে জানা যায়, কীভাবে চীন সরকার দেশের বাইরের নাগরিকদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। এসব নথিতে হুমকির পাশাপাশি আইনি ফাঁদ এবং বিচারবহির্ভূত চাপ প্রয়োগের বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়ামের (ICIJ) ‘China Targets’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের অধীনে, চীনের বাইরে ভিন্নমত দমন করতে চীন সরকারের কৌশলগুলো নথিভুক্ত করা হয়। এই অনুসন্ধানে ‘দ্য গার্ডিয়ান’, রেডিও ফ্রান্স এবং ‘লে মঁদ’-এর মতো গণমাধ্যমগুলোও যুক্ত ছিল।
তবে, যুক্তরাজ্যের চীনা দূতাবাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, চীনের বিরুদ্ধে ‘আন্তর্জাতিক নিপীড়নে’র যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।
জানা গেছে, এইচ সিঙ্গাপুরের নাগরিক, যিনি চীনের নাগরিকত্বও ধারণ করেন। ঘটনার সময় তিনি ফ্রান্সের বোর্দোতে বসবাস করছিলেন। এর আগে, আর্থিক অপরাধের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে চীনা পুলিশ। এরপর, ইন্টারপোলের আন্তর্জাতিক অপরাধী শনাক্তকরণ ব্যবস্থার মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারি করা হয়। ফরাসি কর্তৃপক্ষ তার পাসপোর্ট জব্দ করে এবং তাকে চীনে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি বিবেচনা করতে শুরু করে।
আদালতে পেশ করা তথ্য অনুযায়ী, জ্যাক মা’র ফোনকলে এইচকে জানানো হয়, চীনের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সান লিজুনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে তার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সানকে ঘুষ গ্রহণ ও শেয়ার বাজার কারসাজির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জ্যাক মা এইচকে বলেছিলেন, “তারা আপনার জন্য নয়, সানের জন্যই এটা করছে।”
সান লি জুন ছিলেন চীনের সাবেক উপ-নিরাপত্তা মন্ত্রী। ২০১৭ সালে বেইজিংয়ের গণতন্ত্রপন্থীদের ওপর দমন-পীড়নের সময় হংকংয়ের নিরাপত্তা তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও তার ওপর ছিল। এইচের ফোন পাওয়ার এক বছর আগে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে, চীনের কেন্দ্রীয় শৃঙ্খলা পরিদর্শন কমিশন (CCDI) সানকে ‘রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা’ এবং ‘কেন্দ্রীয় নীতিমালার বিরোধিতা’ করার জন্য অভিযুক্ত করে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান মূলত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের দমন করার একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
আদালতের নথি অনুযায়ী, জ্যাক মা’কে এই বিষয়ে জড়ানোয় তিনি অসন্তুষ্ট ছিলেন। তিনি এইচকে প্রশ্ন করেন, “কেন আপনি আমাকে এতে জড়াচ্ছেন?”
জানা যায় সান লিজুনের মতো জ্যাক মা’ও শি জিনপিং সরকারের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। ২০২০ সালের অক্টোবরে চীনের আর্থিক নিয়ন্ত্রকদের সমালোচনা করে একটি বক্তৃতা দেওয়ার পর, তার ওপর প্রায় ২৮০ কোটি মার্কিন ডলার জরিমানা করা হয় এবং তিনি জনসম্মুখ থেকে অদৃশ্য হয়ে যান।
এইচকে ফোন করার ছয় মাস পরে, জ্যাক মা জানান, চীনা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তিনি এইচকে বলেন, “তারা আমাকে খুব গুরুত্ব সহকারে কথা বলেছেন। তারা নিশ্চয়তা দিয়েছে, আপনি যদি এখন ফিরে আসেন, তাহলে আপনাকে রেহাই দেওয়া হবে। আপনার আর কোনো উপায় নেই… ফাঁদ আরও কঠিন হবে।”
পরে, জ্যাক মা এইচের আইনজীবীর সঙ্গেও একই কথা বলেন।
এইচ চীন ফেরত যাননি। তার আইনজীবীরা ফরাসি আদালতে তার প্রত্যাবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করেন।
এইচের আইনজীবী ক্লারা জেরার্ড-রড্রিগেজ বলেন, “আমরা জানতাম, এইচ যদি চীনে ফিরে যান, তবে তাকে গ্রেপ্তার করা হবে, আটক করা হবে এবং সম্ভবত নির্যাতন করা হবে। তার কোম্পানির শেয়ারসহ তার অধিকাংশ সম্পদ অন্য কারো কাছে হস্তান্তর করা হবে।”
অনুসন্ধানকারী সংস্থা ‘সেফগার্ড ডিফেন্ডারস’-এর তথ্য অনুযায়ী, চীনে ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত করার হার ৯৯.৯৮ শতাংশ। সংস্থাটি জানিয়েছে, চীনের বিচারব্যবস্থায় জোরপূর্বক গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ব্যাপক।
এইচের বিরুদ্ধে আনা অর্থ পাচারের অভিযোগ, মূলত ‘টুয়ান্ডাই.কম’ নামের একটি ক্রেডিট প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে তার সংযোগের কারণে। এই প্ল্যাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা অবৈধভাবে তহবিল সংগ্রহের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। চীনা পুলিশের ধারণা, এইচ এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত কিছু অর্থ পাচারে সহায়তা করেছেন।
এইচের আইনজীবীরা ফরাসি আদালতে জানিয়েছিলেন, তিনি যে অর্থের উৎস সম্পর্কে অবগত ছিলেন, এমন কোনো প্রমাণ নেই। ফরাসি আদালতের নথিতে অন্তর্ভুক্ত, বন্ধুদের সঙ্গে হওয়া এক কথোপকথনে এইচ তার নির্দোষিতার কথা জানান। তিনি বলেছিলেন, “এগুলোর কিছুই সত্য নয়।”
ইন্টারপোল জানায়, তারা বিশ্বের ‘সবচেয়ে গুরুতর অপরাধীদের’ গ্রেপ্তারের জন্য রেড নোটিশ ব্যবহার করে।
এইচের আইনজীবী ক্লারা জেরার্ড-রড্রিগেজ আরও বলেন, “আমরা দেখেছি এবং প্রকাশ্যে জেনেছি জ্যাক মার অন্তর্ধানের কথা… এই প্রভাবশালী ব্যক্তি, যিনি বিশ্বের প্রতিটি দেশে সুপরিচিত ছিলেন, কয়েক মাস সম্পূর্ণভাবে অদৃশ্য ছিলেন। পরে তিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করে আবার ফিরে আসেন। এইচের কাছ থেকেও একই রকম আনুগত্য প্রত্যাশা করা হচ্ছিল—যেন তিনি প্রমাণ করেন, তিনি কার পক্ষে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান