যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর হয়ে লড়ছে চীনের নাগরিকরা, যাদের অনেকেই ভুল বুঝতে পেরে এখন ফিরতে চাইছে দেশে। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএন-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এক চীনা নাগরিক, যিনি ‘মাইকেল’ ছদ্মনামে পরিচিত, জানিয়েছেন, রুশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরোধের জেরে তাকে ২১ দিন ধরে একটি অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। সেখানে দাঁড়ানোরও জায়গা ছিল না।
জীবন বাঁচানোর সরঞ্জাম নিয়ে কমান্ডারদের সঙ্গে বচসার কারণেই এই শাস্তি পেতে হয়েছিল তাকে।
মাইকেল জানান, প্রথমে তিনি ‘বিদেশি সামরিক জীবনের স্বাদ’ নিতেই ইউক্রেন যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ফ্রন্টলাইনে এক বছর কাটানোর পর তার মনে হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত ছিল ‘ভুল’।
এখন তিনি চান, যারা রাশিয়ান বাহিনীতে যোগ দিতে চাইছে, তারা যেন এই পথে পা না বাড়ায়।
সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাইকেল বলেন, বর্তমানে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের আঘাতে আহত হয়ে সুস্থ হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি আসলে একটি ‘হাস্যকর বিষয়’।
সৈন্যদের দুর্বল সরঞ্জাম, অপর্যাপ্ত সরবরাহ ব্যবস্থা, দুর্ব্যবহার এবং ব্যাপক দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো যুদ্ধের শুরু থেকেই আলোচনায় রয়েছে।
এই যুদ্ধে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় পক্ষই বিদেশি যোদ্ধা নিয়োগ করেছে। তবে, রাশিয়ার হয়ে চীনা ভাড়াটে সৈন্যের বিষয়টি প্রথম বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসে যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানান, তারা এপ্রিলের শুরুতে ২ জন চীনা যোদ্ধাকে বন্দী করেছেন এবং রাশিয়ার হয়ে আরও অনেকে যুদ্ধ করছে।
চীনের প্রতি এর জবাব চেয়েছিল ইউক্রেন। জবাবে চীন জানায়, তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই এবং তারা তাদের নাগরিকদের সামরিক কার্যকলাপে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে।
রাশিয়াও ইউক্রেনের এমন দাবিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দেয়।
তবে, কিয়েভ জানিয়েছে, তাদের কাছে তথ্য আছে যে আরও ১৫৫ জন চীনা নাগরিক রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করছে। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মতে, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
মাইকেল ও রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করা আরেক চীনা নাগরিক সিএনএনকে জানিয়েছেন, তারা আরও কয়েকশো যোদ্ধাকে চেনেন।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের পক্ষেও কিছু চীনা নাগরিক লড়ছে। সিএনএন একটি ব্যাটালিয়নে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে, তবে ইউক্রেনের স্থল বাহিনী তাদের মোট সংখ্যা জানাতে পারেনি, কারণ প্রতিটি ইউনিট সরাসরি জনবল নিয়োগ করে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালানো হচ্ছে, যেখানে ভালো বেতনের প্রলোভন এবং পুরুষত্ব প্রদর্শনের সুযোগের কথা বলে চীনা নাগরিকদের রাশিয়াতে যোগ দিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সিএনএন-এর দেখা এসব ভিডিওতে রুশ ভাষায় কথা বলা হলেও, চীনা ভাষায় অনুবাদও দেখা যায়।
একটি ভিডিওতে চীনা ভাষায় লেখা ছিল, ‘তুমি কি পুরুষ নও? একজন সত্যিকারের পুরুষ হও!’
এই ধরনের ভিডিওর মাধ্যমেই মাইকেলসহ আরও অনেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। তিনি জানান, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মিতে কাজ করার পর ২০১৮ সালে তিনি সেনাবাহিনী ছাড়েন।
এরপর ফ্রন্টলাইনে থাকা চীনা যোদ্ধাদের ভিডিও দেখে তার আবারও সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ জাগে।
মাইকেল বলেন, ‘আমি তখন বেশ উত্তেজিত ছিলাম। চীনের একজন পেশাদার সৈনিক হিসেবে, আমি ভেবেছিলাম এখানে অবদান রাখার একটা সুযোগ আছে।’ তিনি আরও জানান, এর সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক ছিল না, তিনি শুধু যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন।
জানা গেছে, প্রথমে রুশ ভাষায় কথা বলতে না পারায় তাকে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয়নি। পরে তিনি কুখ্যাত ওয়াগনার গোষ্ঠীতে যোগ দেন এবং ডনবাস অঞ্চলে যুদ্ধ করতে যান।
ছয় মাস পর, ২০২৪ সালের মে মাসে, তিনি রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এক বছরের চুক্তি করেন এবং এরপর তাকে বাখমুতে পাঠানো হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, মাইকেল প্রতি মাসে ২,৪০০ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ লক্ষ ৮২ হাজার টাকা) বেতন পেতেন। এছাড়াও, ইউক্রেনের কাছ থেকে এলাকা দখল করতে পারলে অতিরিক্ত বোনাসও পাওয়া যেত।
মাইকেলের মতে, তার অনেক চীনা সহযোদ্ধাই টাকার জন্য এখানে এসেছে। তাদের মতে, ‘টাকা না থাকলে, সম্মানও নেই।’
তিনি আরও জানান, চীনের প্রতিযোগিতামূলক সমাজে তারা নিচু শ্রেণির মানুষ হিসেবে পরিচিত এবং সেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় তাদের মধ্যে এই ধরনের প্রবণতা দেখা যায়।
আরেকজন চীনা নাগরিক, যিনি রাশিয়ার হয়ে যুদ্ধ করেছেন এবং অনলাইনে তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন, সিএনএনকে বলেছেন, ভাড়াটে সৈন্য হিসেবে তিনি যা উপার্জন করতেন, তা দেশে তার আগের উপার্জনের চেয়ে তিনগুণ বেশি ছিল।
অন্যদিকে, ইউক্রেনের হয়ে যুদ্ধ করা চীনা নাগরিকদের অধিকাংশই আদর্শের দ্বারা অনুপ্রাণিত। তাদের মধ্যে একজন, জেসন, যিনি যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছেন, ইউক্রেনের আন্তর্জাতিক লেজিয়নে যোগ দিতে একটি কম্পিউটার সায়েন্স প্রোগ্রাম থেকে পড়াশোনা ছেড়ে দেন।
এছাড়াও, চীনের একটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্রী সোফিও ইউক্রেনীয় আন্তর্জাতিক লেজিয়নে যোগ দেওয়ার জন্য অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছেন।
যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে সবাই একমত হয়েছেন যে যুদ্ধের বাস্তবতা তারা যা ভেবেছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন