ইউরোপীয় ইউনিয়নের শীর্ষ আদালত মাল্টার বিতর্কিত ‘গোল্ডেন পাসপোর্ট’ প্রকল্পকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব প্রদানের যে ব্যবস্থা ছিল, তা এখন বাতিল করতে হবে।
মঙ্গলবার ইউরোপীয় বিচার আদালত (European Court of Justice) এক চূড়ান্ত রায়ে জানায়, এই স্কিমটি ইইউ আইনের পরিপন্থী। আদালতের মতে, মাল্টার এই পদক্ষেপ ছিল সদস্য রাষ্ট্রের নাগরিকত্বের বাণিজ্যিকীকরণ, যা ইউরোপীয় আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
এর ফলে ইইউ’র অভ্যন্তরে সীমান্তবিহীন অঞ্চল তৈরিতে প্রয়োজনীয় পারস্পরিক আস্থার অভাব ঘটেছে বলেও আদালত মত প্রকাশ করে।
আদালতের বিচারকরা মূলত ২০২০ সালের একটি স্কিমের পর্যালোচনা করেছেন। এই স্কিমের অধীনে, যারা মাল্টায় ৭ লক্ষ ৫০ হাজার ইউরো পর্যন্ত বিনিয়োগ করেছেন এবং তাত্ত্বিকভাবে ১২ মাস সেখানে বসবাস করেছেন, তারা নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য ছিলেন।
মাল্টার পাসপোর্ট হাতে পেলে, সেই ব্যক্তি ইইউ’র নাগরিকত্ব পেতেন এবং ইউনিয়নের যে কোনও স্থানে বসবাস ও কাজ করার স্বাধীনতা লাভ করতেন।
স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরেই এই স্কিমের সমালোচনা করে আসছিল। তাদের মতে, এটি অর্থ পাচার, দুর্নীতি এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়িয়ে তোলে।
গার্ডিয়ান পত্রিকার একটি অনুসন্ধানে জানা যায়, মাল্টার সঙ্গে সামান্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কোটিপতিদের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে, এমনকি তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাত্র তিন সপ্তাহ দেশটিতে ছিলেন।
সাংবাদিক ড্যাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে পাওয়া কিছু ইমেইল থেকে জানা যায়, নাগরিকত্ব গ্রহণকারীরা তাদের ভাড়া করা বাড়িগুলো প্রায়ই খালি রাখতেন।
ইউরোপীয় কমিশন (European Commission) ইতোমধ্যেই ‘ইইউ নাগরিকত্ব’ বিক্রির অভিযোগে মাল্টা ও সাইপ্রাসের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ শুরু করেছে। সাইপ্রাস অবশ্য মামলার আগেই তাদের এই স্কিম বন্ধ করে দেয়।
কিন্তু মাল্টা সরকার এক্ষেত্রে অনড় ছিল। তারা আদালতের কাছে যুক্তি দিয়েছিল যে, নাগরিকত্ব প্রদানের একচ্ছত্র অধিকার তাদের রয়েছে এবং সেই কারণে এই স্কিম চালু রাখার অধিকার তাদের আছে।
আদালতের এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মাল্টা সরকার জানিয়েছে, তারা এর আইনি প্রভাবগুলি খতিয়ে দেখছে, যাতে নাগরিকত্বের বিষয়ে তাদের নীতিগুলি আদালতের নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা যায়।
একইসঙ্গে, তারা স্কিমের সুবিধাগুলিও তুলে ধরেছে। তাদের মতে, ২০১৫ সাল থেকে এই স্কিম সরকারের জন্য ১.৪ বিলিয়নের বেশি ইউরো রাজস্ব তৈরি করেছে।
মাল্টার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জোসেফ মাসকাট এক ফেসবুক পোস্টে এই রায়কে রাজনৈতিক রায় হিসেবে অভিহিত করেছেন। গোল্ডেন পাসপোর্ট স্কিম চালু করার সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
২০১৭ সালে সাংবাদিক ড্যাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার হত্যার তদন্তে তার বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠলে তিনি ২০২০ সালে পদত্যাগ করেন।
ইউরোপে আর্থিক সংকটের পরে, অর্থের সংস্থান করতে বিভিন্ন দেশ এ ধরনের স্কিম চালু করে। ব্রিটেন সরকারও ফেব্রুয়ারি ২০২২-এ দুর্নীতি ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত উদ্বেগের কারণে তাদের ‘টায়ার ১ ইনভেস্টর ভিসা’ বাতিল করে।
একই পথে হেঁটে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও ধনী বিদেশিদের জন্য একটি ‘গোল্ড কার্ড’ ভিসা চালু করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন, যার মাধ্যমে তারা ৫০ লক্ষ ডলার বিনিয়োগ করে সেখানে বসবাসের অনুমতি পেতে পারতেন।
ড্যাফনে কারুয়ানা গালিজিয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ম্যাথিউ কারুয়ানা গালিজিয়া এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি মাল্টার জনগণের এবং ইইউ’র সকল বাসিন্দাদের জয়, যারা দুর্নীতিগ্রস্তদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ছিলেন।
তিনি সরকারকে অবিলম্বে বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব প্রকল্প বাতিল করার আহ্বান জানান।
ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র আদালতের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে মাল্টাকে রায়টি কার্যকর করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “ইউরোপীয় নাগরিকত্ব বিক্রির জন্য নয়। বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্বের স্কিমগুলি ইইউ আইন লঙ্ঘন করে এবং এটি সকল সদস্য রাষ্ট্রের দ্বারা বাতিল করা উচিত।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান