ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) কর্মীদের উপর ইসরায়েলি বাহিনীর নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছে।
সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের বেশ কয়েকজন কর্মীকে আটক করে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
সংস্থা প্রধান ফিলিপ লাজারিণী এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, গাজায় ১৮ মাস ধরে চলা যুদ্ধের সময় শিক্ষক, চিকিৎসক ও সমাজকর্মীসহ ৫০ জনের বেশি কর্মীকে আটক করা হয়েছে।
আটককৃতদের উপর চালানো হয়েছে অবর্ণনীয় নির্যাতন।
তাদের মারধর করা হয়েছে এবং মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
এছাড়া, তাদের ঘুমোতে দেওয়া হয়নি, অপমান করা হয়েছে, তাদের ও তাদের পরিবারের সদস্যদের ক্ষতির হুমকি দেওয়া হয়েছে এবং কুকুরের মাধ্যমে আক্রমণ করা হয়েছে।
এমনকি তাদের কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে।
জাতিসংঘের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গাজা ও ইসরায়েলের সামরিক বন্দীশালায় এই ধরনের নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
যদিও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী সরাসরি লাজারিনির এই অভিযোগের জবাব দেয়নি, তবে তারা তাদের আটক কেন্দ্রগুলোতে কর্মীদের উপর ব্যাপক নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তবে, তারা জানিয়েছে, সৈন্যদের দ্বারা বন্দী নির্যাতনের কিছু ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা ইসরায়েলি ও আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করে এবং তাদের হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষা করে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “আটক বা জিজ্ঞাসাবাদের সময় বন্দী নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটলে তা আইন ও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) নির্দেশনার পরিপন্থী এবং তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।”
এদিকে, ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (পিআরসিএস) জানিয়েছে, গত ২৩শে মার্চ গাজার দক্ষিণে ইসরায়েলি বাহিনীর অ্যাম্বুলেন্সের উপর মারাত্মক হামলার পর থেকে আটককৃত এক চিকিৎসককে তারা মুক্তি দিয়েছে।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যালয় (ওসিএইচএ) অনুসারে, ওই হামলায় পিআরসিএস-এর আটজন এবং একজন ইউএনআরডব্লিউএ কর্মী নিহত হয়েছেন।
এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাস যোদ্ধাদের অপ্রত্যাশিত হামলার পর থেকে ইসরায়েল ও ইউএনআরডব্লিউএর মধ্যে সম্পর্ক আরও খারাপ হয়েছে।
হামাসের ওই হামলায় বেশিরভাগ বেসামরিক নাগরিকসহ ১,২০০ জন নিহত হয়েছিল এবং ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল।
ইসরায়েল ইতোমধ্যেই গাজায় ইউএনআরডব্লিউএর কার্যক্রমের সঙ্গে সহযোগিতা বন্ধ করে দিয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে হামাসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে।
যদিও ইউএনআরডব্লিউএ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের মানবিক দায়িত্বের বিষয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার বক্তব্য শুনছে।
ইসরায়েলের তরফে গাজায় ইউএনআরডব্লিউএর কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও এখানে প্রধান উদ্বেগের বিষয়।
যদিও ইসরায়েল আইসিজে-তে অংশ নিচ্ছে না, তবে তারা এই শুনানিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে “নিয়মিত নিপীড়ন ও অগ্রহণযোগ্যতা” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডিয়ন সার বলেছেন, এই শুনানি “ইসরায়েলকে হয়রানি করার জন্য আইনি প্রক্রিয়ার অপব্যবহারের আরেকটি প্রচেষ্টা।”
গাজায় অবিরাম বোমা হামলা চলছে, যার ফলে সেখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের মতে, গত ৩৬ ঘণ্টায় অন্তত ২৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, বিমান হামলায় তিনজন মিলিশিয়া কমান্ডার নিহত হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের অধীনে বেসামরিক ক্ষতি কমানোর জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৮ই মার্চ ইসরায়েল একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেওয়ার পর থেকে ৭৩২ জন শিশুসহ ২,১৫১ জন নিহত হয়েছেন।
প্রায় দুই মাস আগে ইসরায়েল গাজায় কঠোর অবরোধ আরোপ করে, যার ফলে খাদ্য, জ্বালানি, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসের প্রবেশ বন্ধ হয়ে যায়।
ইসরায়েলের দাবি, এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হল হামাসকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে বাধ্য করা এবং মানবিক সহায়তা চুরি করা থেকে বিরত রাখা।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে “অনাহার কৌশল” ব্যবহারের অভিযোগ এনেছে, যা পুরো জনসংখ্যার জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে এবং এটিকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতে পারে।
মানবিক কর্মীরা বলছেন, সরবরাহ দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে এবং বেশিরভাগ মানুষ দিনে এক বেলা বা তার কম খাচ্ছে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) এবং ইউএনআরডব্লিউএর মতো প্রধান সংস্থাগুলো তাদের শেষ মজুত করা আটা ও অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, অপুষ্টির মাত্রা বাড়ছে।
হামাস এখনও ৫৯ জন জিম্মিকে ধরে রেখেছে, যাদের মধ্যে ২৪ জন জীবিত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা এখনো পর্যন্ত কার্যত থমকে আছে।
তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মে মাসে সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের আসন্ন সফরের কারণে ইসরায়েলের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ বাড়তে পারে এবং এর ফলে একটি চুক্তির সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে।
গাজায় অভিযান শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি বাহিনী সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বেশিরভাগ নারী ও শিশুসহ ৫২,০০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।
বোমা হামলা এবং স্থল অভিযানে বিশাল এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং প্রায় ৮০% মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যাদের অনেকে ১০ বারের বেশি উদ্বাস্তু হয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা করেছেন, জিম্মিদের ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত এবং হামাসকে হয় ধ্বংস করতে হবে, না হয় অস্ত্র ত্যাগ করে এলাকা ছাড়তে রাজি করাতে হবে, ততদিন পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান