ঘড়ির কারুশিল্প: এক সময়ের মৃতপ্রায় পেশা, কিভাবে ফিরছে পুরোনো ঐতিহ্য?
বর্তমান ডিজিটাল যুগে যখন ঘড়ি দেখা হয় মোবাইল ফোনে, তখন ঘড়ি তৈরি করার মতো একটি পুরনো পেশা কিভাবে আবার নতুন করে আগ্রহ তৈরি করছে, সেটি সত্যিই বেশ কৌতূহলোদ্দীপক।
সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড এবং জার্মানির মত দেশগুলোতে ঘড়ি তৈরি বা watchmaking-এর পুরনো ঐতিহ্য আবার ফিরে আসছে, যা আজকের দিনে অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে।
ডিজিটাল প্রযুক্তির দাপটে যেখানে সবকিছুই সহজলভ্য, সেখানে এই হাতে গড়া, সূক্ষ্ম কারুকার্যখচিত ঘড়ির কদর বাড়ছে, যা আমাদের দেশের মানুষের জন্যেও অনুকরণীয় হতে পারে।
আসলে, এই পরিবর্তনের পেছনে কাজ করছে কিছু বিশেষ কারণ।
প্রথমত, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অ্যানালগ জিনিসের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে, তারা কম্পিউটার স্ক্রিনের জগৎ থেকে দূরে থাকতে চাইছে।
দ্বিতীয়ত, হাতে তৈরি জিনিসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে, যা কেবল সময় দেখানোর যন্ত্র নয়, বরং একটি শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, জার্মানিতে Kallinich Claeys নামের একটি ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা ক্লাসিক এবং আধুনিক উপাদানের মিশ্রণে ঘড়ি তৈরি করছে, যা তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে।
তাদের ঘড়ির ডিজাইন এবং কারিগরি দক্ষতা, উভয়ই প্রশংসিত হচ্ছে।
তাদের তৈরি করা ঘড়িগুলি একদিকে যেমন ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে, তেমনই আধুনিক রুচির সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ।
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, অনেক বয়স্ক মানুষও এই পেশায় আসছেন।
অনেকে পুরনো চাকরি ছেড়ে ঘড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, কারণ তারা চান হাতে-কলমে কাজ করতে এবং নিজেদের দক্ষতা দিয়ে কিছু তৈরি করতে।
এই পেশায় আগ্রহীদের মধ্যে ৪০ বছর ব্যাংকের চাকরি করার পর WOSTEP-এর একটি কোর্সে ভর্তি হওয়া একজন ব্যক্তির উদাহরণ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ফিনল্যান্ডের কেলোসেপ্পাকুউলো (Kelloseppäkoulu) ঘড়ি তৈরির স্কুল, যা তাদের ছাত্রদের হাতে ঘড়ি তৈরির প্রশিক্ষণ দেয়, তারাও এই চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত হচ্ছে।
তারা তাদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ভাষায় একটি কোর্স চালু করেছে, যেখানে বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা অংশ নিচ্ছে।
তবে, ঘড়ি তৈরির জগতে নারীদের উপস্থিতি এখনো তুলনামূলকভাবে কম।
ঐতিহাসিকভাবে, এই পেশায় নারীদের ভূমিকা ছিল মূলত কারখানার লাইনে কাজ করা বা তাদের ঘড়ি প্রস্তুতকারক স্বামীদের সহযোগিতা করা।
তবে বর্তমানে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে।
তরুণ ঘড়ি প্রস্তুতকারক শোনা টেইন-এর (Shona Taine) মতো নারীরা এই পেশায় নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছেন।
তিনি সম্প্রতি অ্যাকাডেমি হোরলজিয়ার দেস ক্রিয়েটরস ইন্ডিপেন্ডেন্টস (Académie Horlogère des Créateurs Indépendants)-এ প্রথম নারী হিসেবে, এবং সর্বকনিষ্ঠ ব্যক্তি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন।
এই পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে বিশ্বজুড়ে।
ঘড়ি প্রস্তুতকারকদের সংগঠন এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোও তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে।
তারা নতুন প্রজন্মের জন্য কর্মশালার আয়োজন করছে এবং ঐতিহ্যবাহী ঘড়ি তৈরির পদ্ধতিগুলো শেখাচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, জেনেভাতে অনুষ্ঠিত ‘ওয়াচেস অ্যান্ড ওয়ান্ডার্স’ (Watches and Wonders) শীর্ষক একটি প্রদর্শনীতে তরুণদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
তাহলে, ঘড়ি তৈরির এই পুনর্জাগরণ আমাদের কী শেখায়?
এর প্রধান বার্তা হলো, হাতের কাজের প্রতি মানুষের আগ্রহ এখনো ফুরিয়ে যায়নি।
বরং, ডিজিটাল দুনিয়ায় যখন সবকিছু দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে, তখন মানুষ এমন কিছু চাইছে যা তাদের জীবনের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করতে পারে।
আমাদের দেশের জামদানি শিল্পের মতো ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পগুলোও ঘড়ি তৈরির এই উত্থান থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
পুরোনো দিনের কারুশিল্পকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করে, তরুণ প্রজন্মের কাছে এর আবেদন বাড়ানো সম্ভব।
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এই শিল্পকর্মগুলো আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়।
ঘড়ি তৈরির এই নতুন যাত্রা, আমাদের ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার পাশাপাশি, নতুন প্রজন্মের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে পারে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন