জীবনে পরিপূর্ণতা আসলে কী? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কয়েক দশক ধরে গবেষণা চালিয়েছেন অধ্যাপক টাইলার জে. ভ্যান্ডারউইলে। মানুষের ভালো থাকার সংজ্ঞা এবং তা পরিমাপ করার পদ্ধতি নিয়ে তিনি ছিলেন সন্দিহান।
হতাশা, উদ্বেগ, অথবা আনন্দের মতো মানসিক অবস্থাগুলো নিয়ে অনেক গবেষণা হলেও, জীবনের গভীরতা উপলব্ধির ক্ষেত্রে যেন কিছু একটা Missing থেকে যাচ্ছিলো। স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মানুষের জীবনযাত্রায় কীভাবে প্রভাব ফেলে, সে বিষয়েও বিভিন্ন গবেষণা হয়েছে।
কিন্তু অধ্যাপক ভ্যান্ডারউইলের মনে হয়েছিল, এই গবেষণাগুলো মানুষের সামগ্রিক জীবনযাত্রার ছবিটা সম্পূর্ণভাবে ফুটিয়ে তোলে না। মানুষের জীবনে অর্থ এবং আনন্দের বাইরেও এমন কিছু বিষয় রয়েছে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেমন – জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া।
এই উপলব্ধি থেকেই তিনি এবং তার দল ‘ফ্লারিশিং’ বা ‘বিকশিত হওয়া’ ধারণাটির জন্ম দেন। তাদের মতে, ‘ফ্লারিশিং’ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক ভালো থাকে।
পরবর্তীতে তারা এই ধারণাকে আরও বিস্তৃত করেন এবং ব্যক্তির চারপাশের পরিবেশ ও সমাজের প্রেক্ষাপটও এর সঙ্গে যুক্ত করেন।
‘ফ্লারিশিং’ ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বিভিন্ন উপায়ে অর্জন করা সম্ভব। একজন মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক নিখুঁত না হলেও, তিনি বিকশিত হতে পারেন।
মানুষের জীবনে এমন কিছু বিষয় আছে যা তাদের কাছে মূল্যবান, যা তাদের জীবনের উদ্দেশ্য তৈরি করে।
এই ধারণা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ভ্যান্ডারউইলে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বায়রন আর জনসনের সঙ্গে হাত মেলান। তাঁরা ‘ফ্লারিশিং’-এর বিজ্ঞানসম্মত পরিমাপ তৈরি করার জন্য গবেষণা শুরু করেন।
এই গবেষণার অংশ হিসেবে, ‘গ্লোবাল ফ্লারিশিং স্টাডি’ নামে একটি বিশাল প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এই প্রকল্পের আওতায়, ২৩টি দেশের ২ লক্ষাধিক মানুষের ওপর পাঁচ বছর ধরে জরিপ চালানো হয়।
এই জরিপে মানুষের মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করা হয়েছে। সম্প্রতি ‘নেচার মেন্টাল হেলথ’ জার্নালে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়েছে, যা মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে।
গবেষণার একটি প্রধান দিক হলো, সমাজে পারস্পরিক সম্পর্ক বা কমিউনিটির গুরুত্ব। বিশেষ করে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, আত্মনির্ভরশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষের ভালো থাকার জন্য একে অপরের প্রতি নির্ভরশীলতা অপরিহার্য।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ‘ফ্লারিশিং’-এর হার তুলনামূলকভাবে কম। অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশগুলোতেও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি, মহামারীর প্রভাব, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা—এসব কারণে তরুণরা ভালো নেই বলে মনে করা হচ্ছে।
তবে, এই গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং ‘ফ্লারিশিং’-এর মধ্যে সরাসরি সম্পর্ক নাও থাকতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে, কম আয়ের দেশগুলোতে মানুষের মধ্যে জীবনের গভীরতা এবং ভালো থাকার অনুভূতি বেশি দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইন্দোনেশিয়ার কথা বলা যায়।
এখানকার মানুষের গড় ‘ফ্লারিশিং’ স্কোর উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হয়, ইন্দোনেশিয়ার সংস্কৃতিতে সামাজিক বন্ধন এবং কমিউনিটির প্রতি গুরুত্ব রয়েছে।
অন্যদিকে, জাপানের মতো উন্নত দেশে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকা সত্ত্বেও ‘ফ্লারিশিং’-এর হার কম। জাপানে জন্মহার হ্রাস, পরিবারের মধ্যে সমস্যা এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মতো বিষয়গুলো এর কারণ হতে পারে।
তাহলে, কীভাবে আমরা আমাদের জীবনকে আরও উন্নত করতে পারি? এই গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপন এবং কমিউনিটিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে আমরা ভালো থাকতে পারি।
বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে, যেমন— খেলাধুলা, স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ, অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে সামাজিক সংযোগ বাড়ানো যেতে পারে।
এছাড়াও, পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানো এবং বন্ধুদের সঙ্গে খাবার খাওয়ার মতো ছোট ছোট বিষয়গুলোও আমাদের জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সুতরাং, ‘ফ্লারিশিং’ কোনো চূড়ান্ত গন্তব্য নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। আমাদের সবারই উচিত নিজেদের জীবনকে আরও অর্থবহ করে তোলার জন্য সচেষ্ট হওয়া।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক