স্মৃতিভ্রংশ রোগের চিকিৎসার পথ আরও একধাপ এগোনো গেল। সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা মানব মস্তিষ্কের জীবন্ত কোষ ব্যবহার করে আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন।
এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের ফলে রোগটি নিরাময়ের গবেষণা আরও দ্রুত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের একদল বিজ্ঞানী তাদের গবেষণায় আলঝেইমার রোগে মৃত রোগীদের মস্তিষ্ক থেকে সংগৃহীত একটি বিষাক্ত প্রোটিন (যা অ্যামাইলয়েড বিটা নামে পরিচিত) ব্যবহার করেছেন।
তাঁরা সুস্থ মানুষের মস্তিষ্কের টিস্যুতে এটি প্রবেশ করিয়ে দেখেন, কীভাবে এটি মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ নষ্ট করে দেয়।
এই গবেষণাটি সত্যিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের মস্তিষ্কের কোষে স্মৃতিভ্রংশ রোগের প্রক্রিয়া সরাসরি দেখতে পাচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই পদ্ধতিতে রোগটি নিয়ে গবেষণা করা হলে নতুন ওষুধ তৈরি এবং তা পরীক্ষার সুযোগ বাড়বে, যা চিকিৎসা পদ্ধতিকে আরও উন্নত করবে।
বর্তমানে সারা বিশ্বে স্মৃতিভ্রংশ একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ এই রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বর্তমানের তুলনায় তিনগুণ বেড়ে ১৫ কোটিতে পৌঁছাতে পারে।
তাই, এই রোগ নিয়ে নতুন গবেষণা এবং দ্রুত চিকিৎসার পথ খোঁজা অত্যন্ত জরুরি।
এডিনবার্গের বিজ্ঞানীরা এবং নিউরোসার্জনদের একটি দল তাদের গবেষণায় দেখিয়েছেন, কীভাবে অ্যামাইলয়েড বিটা প্রোটিন মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করে এবং তা নষ্ট করে দেয়।
তাঁরা ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের শরীর থেকে ছোট ছোট সুস্থ মস্তিষ্কের টিস্যু সংগ্রহ করেন। এরপর, এই টিস্যুগুলোকে একটি বিশেষ তরলে রেখে শরীরের তাপমাত্রার (৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস) কাছাকাছি একটি ইনকিউবেটরে রাখা হয়।
গবেষকরা জানিয়েছেন, তাঁরা আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত রোগীদের শরীর থেকে অ্যামাইলয়েড বিটা সংগ্রহ করে সুস্থ মস্তিষ্কের টিস্যুতে প্রবেশ করিয়েছেন।
তাঁরা আলঝেইমার রোগের প্রক্রিয়াটিকে অনুকরণ করার চেষ্টা করেছেন। তাঁরা আরও দেখেছেন, এই বিষাক্ত প্রোটিনের কারণে মস্তিষ্কের কোষগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি, অ্যামাইলয়েড বিটার সামান্য পরিবর্তনও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ব্যাহত করতে পারে।
গবেষক দলের প্রধান, ড. ক্ল্যারি ডুরান্ট বলেছেন, “আমরা এডিনবার্গের নিউরোসার্জারি দলের সঙ্গে কাজ করে দেখিয়েছি যে, মানব মস্তিষ্কের জীবন্ত কোষ ব্যবহার করে আলঝেইমার রোগ সম্পর্কিত মৌলিক প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা সম্ভব।”
তাঁর মতে, এই পদ্ধতি গবেষণাগারের ফলাফল রোগীদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে, যা আমাদের স্মৃতিভ্রংশমুক্ত একটি পৃথিবীর আরও কাছাকাছি নিয়ে যাবে।
এই আবিষ্কারের ফলে বিজ্ঞানীরা এমন ওষুধ তৈরি করতে পারবেন যা মস্তিষ্কের কোষগুলোর মধ্যে সংযোগ রক্ষায় সাহায্য করবে। কারণ, আলঝেইমার রোগে এই সংযোগগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যার ফলে স্মৃতিশক্তি এবং চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
গবেষকরা আরও দেখেছেন যে, মস্তিষ্কের যে অংশটি (টেম্পোরাল লোব) আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে টাউ নামক একটি প্রোটিনের পরিমাণ বেশি থাকে। সম্ভবত, এই কারণেই মস্তিষ্কের ওই অংশটি রোগের শুরুতে বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে।
এই গবেষণায় ‘রেস অ্যাগেইনস্ট ডিমেনশিয়া’ নামক একটি সংস্থা এবং জেমস ডাইসন ফাউন্ডেশন আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
স্যার জ্যাকি স্টুয়ার্ট, যিনি তাঁর স্ত্রীর স্মৃতিভ্রংশ রোগ ধরা পড়ার পর এই সংস্থাটি তৈরি করেন, তিনি এই আবিষ্কারকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
জেমস ডাইসন বলেছেন, “মানব মস্তিষ্কের জীবন্ত কোষ নিয়ে কাজ করা একটি যুগান্তকারী পদ্ধতি। এর মাধ্যমে গবেষকরা ইঁদুরের মতো প্রাণীর পরিবর্তে মানুষের মস্তিষ্কের কোষের ওপর আলঝেইমার রোগের প্রভাব আরও ভালোভাবে পরীক্ষা করতে পারবেন।”
ইউকে ডিমেনশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তারা স্পায়ার্স-জোনস এই গবেষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
তাঁর মতে, মানুষের মস্তিষ্কের জীবন্ত কোষ ব্যবহার করে আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায় পর্যবেক্ষণ করা বিজ্ঞানীদের জন্য রোগটি ভালোভাবে বুঝতে এবং এর চিকিৎসার পথ খুঁজে বের করতে সহায়ক হবে।
তিনি আরও বলেন, “মস্তিষ্কের টিউমারের অস্ত্রোপচারের সময় রোগীদের কাছ থেকে পাওয়া টিস্যু ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা আলঝেইমারের কারণে সৃষ্ট বিষাক্ত প্রোটিনের প্রতি মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন, যা ভবিষ্যতে নতুন চিকিৎসার কার্যকারিতা পরীক্ষার সুযোগ তৈরি করবে।”
তথ্য সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান