যুদ্ধ এবং ছবির ভাষা: গাজা থেকে ভিয়েতনাম পর্যন্ত
সংবাদ জগতে এমন কিছু ছবি আছে যা শুধু একটি মুহূর্তের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং যুদ্ধের বিভীষিকা আর মানব হৃদয়ের গভীর ক্ষতকে যেন জীবন্ত করে তোলে।
সম্প্রতি, ২০২৩ সালের বিশ্ব প্রেস ফটো অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার জিতেছে ফিলিস্তিনি আলোকচিত্রী সামার আবু এল-ওউফের তোলা একটি ছবি। ছবিতে দেখা যায়, গাজায় ইসরায়েলি হামলায় আহত নয় বছর বয়সী মাহমুদ আজ্জুরকে।
বোমা হামলায় শিশুটির দুটি হাতই উড়ে যায়। ছবিটি যেন যুদ্ধের ভয়াবহতা আর শিশুদের প্রতি হওয়া নিষ্ঠুরতার নীরব সাক্ষী।
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে অক্টোবর ২০২৩ থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫২,৩৬৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত শিশুদের আর্তনাদ আর স্বজন হারানোর বেদনায় সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে আছে।
ছবিটিতে আজ্জুরের মুখচ্ছবিতে ফুটে ওঠা গভীর দৃষ্টি, যেন পুরো বিশ্বের কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়—যুদ্ধ নামক এই ধ্বংসযজ্ঞের শেষ কোথায়?
আহত শিশু আজ্জুরের মা যখন তাকে জানান, তার হাত নেই, তখন তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘আমি কীভাবে তোমাকে জড়িয়ে ধরব?’
এই একটি প্রশ্নই যেন যুদ্ধের নিষ্ঠুর বাস্তবতাকে উন্মোচন করে দেয়। যুদ্ধের ভয়াবহতা শিশুদের জীবনকে কীভাবে তছনছ করে দেয়, আবু এল-ওউফের ছবিটি তারই প্রমাণ।
অন্যদিকে, ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা আজও বিশ্ববাসীর মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে।
সেই যুদ্ধের স্মৃতি আজও অম্লান। ৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫ তারিখে ভিয়েতনাম যুদ্ধের অবসান হয়, যা ছিল মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
এই যুদ্ধেও শিশুদের ওপর নেমে এসেছিল অবর্ণনীয় দুঃখ আর যন্ত্রণা।
১৯৭২ সালে, দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি গ্রামে মার্কিন ন্যাপাম বোমা হামলায় আহত নয় বছর বয়সী কিম ফুক-এর ছবি তুলেছিলেন এপি’র (Associated Press) আলোকচিত্রী নিক উট।
‘ন্যাপাম গার্ল’ নামে পরিচিত সেই ছবিটি ১৯৭৩ সালে বিশ্ব প্রেস ফটো অফ দ্য ইয়ার পুরস্কার লাভ করে।
আগুনে ঝলসে যাওয়া নগ্ন শরীর নিয়ে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছিল কিম, তার চোখে-মুখে ছিল তীব্র যন্ত্রণার ছাপ।
ছবিটি যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। কিম ফুক-এর সেই আর্তনাদ, যা আজও আমাদের হৃদয়ে বাজে।
যুদ্ধ শিশুদের কাছ থেকে কেড়ে নেয় স্বাভাবিক জীবন, কেড়ে নেয় তাদের ভবিষ্যৎ।
আহত কিম ফুক-কে ১৪ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি, ছবিটির কারণে তিনি মানসিক আঘাতও পেয়েছিলেন।
যুদ্ধ সব সময়ই ধ্বংস ডেকে আনে।
ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাপাম বোমা হামলার পাশাপাশি, ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ নামক রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহার সেখানকার মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল।
আজও সেখানকার মানুষ বিকলাঙ্গ হয়ে জন্ম নিচ্ছে, মারা যাচ্ছে বিভিন্ন রোগে।
বর্তমানে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি ও ভিডিওর অবাধ প্রবাহের কারণে মানুষের মধ্যে সংবেদনশীলতা কমছে।
যুদ্ধের ভয়াবহতা যেন দ্রুতই একটি সাধারণ দৃশ্যে পরিণত হচ্ছে।
আবু এল-ওউফ তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন, ‘আমি সবসময় চেয়েছি এমন একটি ছবি তুলতে যা এই যুদ্ধকে থামাতে পারে—হত্যা, মৃত্যু, ক্ষুধা বন্ধ করতে পারে।’
কিন্তু ছবি কি পারবে যুদ্ধ থামাতে?
যদি ছবি পারে, তাহলে গাজায় চলমান এই ট্র্যাজেডি কেন বন্ধ হচ্ছে না?
ছবি যদি পারে, তবে কেন এত শিশুর আর্তনাদ? এই প্রশ্নগুলো আজও আমাদের তাড়িত করে।
তথ্যসূত্র: আল জাজিরা