শিরোনাম: সঙ্গমের পর যখন এক স্কুইড মায়ের মৃত্যু হয়, অপ্রত্যাশিত এক বন্ধু তার বাচ্চাদের সাহায্য করে
সাগরের গভীরে, জীবনের এক আশ্চর্য লীলাখেলা চলে সবসময়। সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা, তাদের সম্পর্ক—সবকিছুই যেন এক রহস্যে মোড়া।
সম্প্রতি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক-এর একটি প্রতিবেদনে তেমনই এক ঘটনার কথা জানা গেছে, যেখানে একটি স্কুইড মায়ের মৃত্যুর পর তার শিশুদের জীবন বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসে এক অদ্ভূত বন্ধু।
ডোরিটিউথিস্ ওপালেসেন্স (Doryteuthis opalescens) প্রজাতির স্কুইড-এর জীবন বড়ই সংক্ষিপ্ত। জীবনের শেষ প্রান্তে তারা এক বিশেষ প্রজনন প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়, যা সমুদ্রের গভীরে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের অবতারণা করে।
পূর্ণিমার আলোয়, ঝাঁকে ঝাঁকে স্কুইডগুলো মিলিত হয় এবং তাদের মধ্যে চলে তীব্র মিলন প্রক্রিয়া। এই সময়ে পুরুষ স্কুইডগুলি মায়ের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে যে, এতে মা স্কুইডের শরীর দুর্বল হয়ে যায়।
এই নৃশংস ঘটনার শেষে মা এবং তার সঙ্গীরা গভীর সমুদ্রে তলিয়ে যায়, আর তাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকে ডিমের সারি।
এই ডিমগুলো থাকে সাদা, নলাকার ক্যাপসুলের মধ্যে, যা দেখতে অনেকটা আলোকোজ্জ্বল ক্ষেতের মতো। প্রত্যেক ক্যাপসুলে থাকে প্রায় ৩০০টি করে ডিম, যা থেকে জন্ম নেয় ছোট ছোট স্কুইড বা প্যারালার্ভা (paralarvae)।
ডিমগুলো অনেকটা জেলি-র মতো, যাদের মধ্যে থাকে ব্যাকটেরিয়া, যা শিকারীদের থেকে তাদের বাঁচায়।
কিন্তুু এই ডিমগুলো যখন সমুদ্রের বালুকাময় তলদেশে একা থাকে, তখন তাদের উপর আসে এক নতুন বিপদ।
তখনই আবির্ভাব হয় এক ক্ষুদ্র, নিরীহ জীবের—ক্যাপিটেলা ওভিনকোলা (Capitella ovincola) নামক সামুদ্রিক কীট।
তারা ডিমগুলোর কাছে যায় এবং ডিমের বাইরের আবরণ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করে।
কৌতূহলের বিষয় হলো, এই কীটগুলো ডিমের কোনো ক্ষতি করে না, বরং তারা যেন এক প্রকার ধাত্রীর মতো কাজ করে।
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির মেরিন বায়োলজির অধ্যাপক লউ জেইডবার্গ-এর মতে, এই কীটগুলো ডিমের বাইরের জেলি জাতীয় পদার্থ (chorion) খেয়ে ফেলে, যা শত শত ভ্রূণকে আলাদা করে রাখে।
ফলে, ছোট স্কুইডদের ডিম ফুটে বের হতে সুবিধা হয়।
জেইডবার্গ আরও জানান, কীটগুলোর কারণে ডিমের ক্যাপসুলে ছিদ্র তৈরি হয়, যার ফলে সমুদ্রের জল ভেতরে প্রবেশ করে এবং ক্যাপসুলটি নরম হয়ে যায়।
এর ফলে, প্যারালার্ভা সহজে সেই নরম আবরণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে পারে।
এই কীটগুলো একদিকে যেমন ডিমের পুষ্টি গ্রহণ করে, তেমনই তারা স্কুইড-এর ডিম ফুটে বের হতে সাহায্য করে।
এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা বা সিম্বায়োসিস-এর ফলে প্রতি “প্রজনন চক্র”-এ প্রায় ১ কোটি ৭০ লক্ষ বেশি স্কুইড জন্ম নিতে পারে।
জেইডবার্গ বলেন, “ডিম ফুটে বের হওয়াটাই তো সব নয়, কারণ একটি ছোট স্কুইডের জীবন খুবই কঠিন।
তাদের ভালোভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অনেক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়।
তবে, সব বিজ্ঞানীই যে এই কীটদের উপকারক মনে করেন, তা নয়।
১৯৪৪ সালে প্রথম এই সম্পর্কটি আবিষ্কার করেন আমেরিকান ইনভার্টিব্রেট জুওলজিস্ট ওলগা হার্টম্যান।
কিন্তুু ২০০২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কীটদের কার্যকলাপের ফলে ডিমের বাইরের আবরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং অপরিণত স্কুইড জন্ম নেয়, যা তাদের মৃত্যুর কারণ হয়।
সমুদ্রবিজ্ঞানী গ্রেগ রুজ-এর মতে, “ক্যাপিটেলা কীটগুলি সাধারণত জল দূষণের কারণে দ্রুত বৃদ্ধি পায়।
তাই, এই কীটদের উপস্থিতি একদিকে যেমন ডিম ফুটে সাহায্য করতে পারে, তেমনই তাদের বেশি উপস্থিতি স্কুইডদের জীবনহানির কারণও হতে পারে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, সমুদ্রের গভীরে জীবনের জটিলতা এবং পারস্পরিক সম্পর্ক কত বিচিত্র।
মা স্কুইডের মৃত্যুর পরেও, ক্ষুদ্র কীটদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দেয়— প্রকৃতির বুকে সবাই একা নয়, সবাই কারো না কারো বন্ধু।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক