লস অ্যাঞ্জেলেসে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া হাজারো মানুষের জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা, প্রতি ডলার = ১১০ টাকা ধরে) বিশাল অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে রাজি হয়েছে কর্তৃপক্ষ। এই ঘটনার শিকার হওয়া ভুক্তভোগীদের অনেকের অভিযোগ, এই ক্ষতিপূরণ তাদের ওপর হওয়া দশকের পর দশক ধরে চলা নির্যাতনের ক্ষত মোছাতে পারবে না।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি তাদের অধীনে থাকা বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের ওপর হওয়া যৌন নির্যাতনের শিকার প্রায় ৭ হাজার মানুষের ক্ষতিপূরণের বিষয়টি অনুমোদন করেছে। জানা গেছে, নির্যাতনের এই ঘটনাগুলো ১৯৫০ সাল থেকে ২০০০-এর দশকে ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ক্ষতিপূরণের এমন ঘটনা নজিরবিহীন।
ঐতিহাসিক এই সিদ্ধান্তের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুরা কিছুটা স্বস্তি পেলেও, তাদের অনেকেই মনে করেন, এই অর্থ তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গভীরতা কমাতে পারবে না। নির্যাতনের শিকার হওয়া অনেক শিশুর স্মৃতি আজও তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ম্যাকলারেন চিলড্রেনস সেন্টার নামের একটি আশ্রয়কেন্দ্র। ১৯৬১ সালে শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য এটি খোলা হলেও, পরবর্তীতে সেখানে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত শিশু থাকতে শুরু করে। অনেক শিশুকে দিনের পর দিন, এমনকি মাসের পর মাস সেখানে থাকতে হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তাদের ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালানো হতো, এমনকি মাদক দ্রব্য প্রয়োগ করা হতো। নির্যাতনের শিকার শিশুদের মুখ খুলতে নিষেধ করা হতো এবং তাদের হুমকি দেওয়া হতো।
এই ঘটনার শিকার হওয়া এক ব্যক্তি, ৩৯ বছর বয়সী জোনাথন রাইট, ম্যাকলারেন চিলড্রেনস সেন্টারে প্রথমবার যাওয়ার সময় পাওয়া একটি টি-শার্ট হাতে ধরে ছিলেন। তিনি বলেন, “এই ক্ষতিপূরণ আমার কোনো দুঃখ ঘোচাতে পারবে না।”
আরেক ভুক্তভোগী, ৪৫ বছর বয়সী জিমি ভিজিল বলেন, “আদালত ব্যবস্থা আমাকে কোনো মুক্তি দিতে পারে না। আমি যখন কিশোর ছিলাম, তখন সেখানে বন্দী ছিলাম। সেই সময় যে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম, তা থেকে মুক্তি পেতে বছরের পর বছর ধরে চিকিৎসা নিতে হয়েছে।”
অভিযোগ উঠেছে, সেখানকার তত্ত্বাবধায়ক ও কর্মীরা শিশুদের মারধর করতেন এবং তাদের মধ্যে মারামারি লাগানোর জন্য উৎসাহ দিতেন। যখন কেউ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করতে চাইত, তখন তাদের অভিযোগ শোনা হতো না।
লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির সুপারভাইজার ক্যাথরিন বার্গার এই ক্ষতিপূরণকে একটি “ঐতিহাসিক” সিদ্ধান্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, “যাদের শিশুদের দেখাশোনার দায়িত্ব ছিল, তারাই যদি তাদের সঙ্গে এমন বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে তা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সুরক্ষায় কাউন্টি কর্তৃপক্ষ বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, শিশুদের ওপর নির্যাতন বিষয়ক অভিযোগ জানানোর জন্য একটি হটলাইন চালু করা এবং দ্রুত তদন্তের ব্যবস্থা করা। এছাড়াও, অভিযোগ প্রমাণিত হলে কর্মীদের তাৎক্ষণিক বরখাস্ত করারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে, ভুক্তভোগী জিমি ভিজিলের মতে, প্রকৃত বিচার হলো নির্যাতনকারীদের শাস্তি নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, “আমার কাছে, প্রকৃত বিচার তখনই হবে, যখন শিশুদের ওপর নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় আনা হবে।”
ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে শিশু যৌন নির্যাতন বিষয়ক অভিযোগের সময়সীমা পরিবর্তনের কারণে এই ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সম্ভব হয়েছে। ২০২০ সালে, পুরোনো নির্যাতনের ঘটনাগুলো সামনে আনার জন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়।
ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণের এই অর্থ আগামী বছর থেকে তাদের কাছে পৌঁছানো শুরু হবে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের অর্থ পরিশোধ করা হবে। তবে, ২০৫০ সাল পর্যন্ত এই ক্ষতিপূরণ কার্যক্রম চলমান থাকবে। লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির বার্ষিক বাজেট প্রায় ৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান