যুক্তরাষ্ট্রে শিশু পরিচর্যা খরচের ঊর্ধ্বগতি, কমছে জন্মহার: উদ্বেগে পরিবারগুলো।
যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের দেখাশোনার খরচ ক্রমাগত বাড়ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশটির জন্মহারের ওপর। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশুদের লালন-পালনের ব্যয় এতটাই বেড়েছে যে অনেক পরিবারই এখন সন্তান ধারণের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে শ্বেতাঙ্গ প্রতিনিধিরা যদি মায়েদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার কথা ভাবেন, তাহলেও সম্ভবত সমস্যার সমাধান হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘চাইল্ড কেয়ার অ্যাওয়ার অফ আমেরিকা’র এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, শুধু ২০২২ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সময়ে শিশুদের দেখাশোনার খরচ বেড়েছে প্রায় ২৯ শতাংশ।
একই সময়ে দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (Centers for Disease Control and Prevention)-এর তথ্য অনুযায়ী, জন্মহারও কমে এসেছে, যা উদ্বেগের কারণ। গত বছর প্রতি ১০০০ জন নারীর মধ্যে সন্তান জন্মদানের হার ছিল প্রায় ৫৪.৬, যা আগের বছরের তুলনায় সামান্য বেড়েছে।
তবে, এই হার এখনো অনেক আগের বছরগুলোর তুলনায় কম।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য ও মানব পরিষেবা বিভাগ (US Department of Health and Human Services)-এর মতে, স্বাস্থ্য ও শিশু পরিচর্যা খরচ বেড়ে যাওয়ায় জন্মহার কমার সম্ভবনা রয়েছে। তাদের একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সময়ে জন্মহার ১৭ শতাংশ কমেছে।
প্রতি ১০০০ জনে প্রায় ১৩ জন শিশুর জন্মহার কমে বর্তমানে ১১ জনেরও নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট-এ বসবাসকারী ৩৭ বছর বয়সী ক্রিস্টিন ডেভিস নামের এক নারীর কথা ভাবুন। তিনি একা মা, পেশায় একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।
মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে কাজে ফেরার পর শিশুদের দেখাশোনার বিষয়টি তাঁর কাছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেভিস জানান, পরিবারের অন্য সদস্যদের সহযোগিতায় তিনি তাঁর ১১ সপ্তাহের ছেলেকে দেখাশোনা করার পরিকল্পনা করছেন।
আগস্ট মাস থেকে সপ্তাহে দু’দিন ডে-কেয়ারে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেও তাঁর খরচ হবে ২০০ ডলারের বেশি। এরপর যখন তাঁর ছেলের বয়স ৩ বছর হবে, তখন ডে-কেয়ারে তাকে সপ্তাহে পাঁচ দিন পাঠাতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের দেখাশোনার এই ক্রমবর্ধমান খরচ অনেক মাকে কর্মক্ষেত্র থেকে দূরে থাকতে বাধ্য করছে। ডেভিসের বোন-in-law, ৪৩ বছর বয়সী স্টেফানি ও’সুলিভানের দুটি সন্তান রয়েছে।
তিনি একজন ক্লিনিক্যাল মেন্টাল হেলথ প্র্যাকটিশনার। ছোট ছেলের জন্য প্রি-স্কুলের খরচ দিতে গিয়ে একসময় তাঁকে দ্বিতীয়বার বাড়ির বন্ধক রাখতে হয়েছিল।
ও’সুলিভানের কথায়, “গ্রীষ্মকালে আমার ৮ বছরের ছেলের জন্য স্থানীয় একটি ক্যাম্পে পাঠাতে ৫,০০০ ডলার পর্যন্ত খরচ হবে। প্রতিটি ছুটির দিনে শিশুদের দেখাশোনার ব্যবস্থা করা কঠিন।
আমি আমার প্র্যাকটিস চালাই, যেখানে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আমার কোনো ছুটিও নেই। কাজ না করলে, আমার আয়ও বন্ধ হয়ে যায়।”
যুক্তরাষ্ট্রে শিশুদের দেখাশোনার খরচ এখন এতটাই বেড়েছে যে অনেক ক্ষেত্রে তা বাড়ি ভাড়ার দ্বিগুণ। ‘চাইল্ড কেয়ার অ্যাওয়ার অফ আমেরিকা’র বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শিশুদের দেখাশোনার জাতীয় গড় খরচ দাঁড়িয়েছে বছরে ১৩,১২৮ ডলারে।
এই খরচ একজন একক অভিভাবকের গড় আয়ের প্রায় ৩৫ শতাংশ। যেখানে সরকারের নিয়ম অনুযায়ী, ফেডারেল সাহায্যপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর জন্য এই খরচ তাদের বার্ষিক আয়ের ৭ শতাংশের বেশি হওয়া উচিত নয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিশুদের দেখাশোনার ক্ষেত্রে চাহিদা ও যোগানের মধ্যে একটি বড় পার্থক্য রয়েছে। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকার কারণে খরচ বাড়ছে। এই সমস্যার সমাধানে সরকার, নিয়োগকর্তা এবং শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এছাড়াও, পরিবারগুলোর জন্য শিশুদের দেখাশোনার খরচ বহন করা সহজ করতে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের দেখাশোনার বিষয়টি কেবল অভিভাবকদের একার সমস্যা নয়। শিশুদের দেখাশোনার সঙ্গে যুক্ত কর্মীদেরও উপযুক্ত বেতন দেওয়া উচিত।
বর্তমানে, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন কেন্দ্রে কর্মরত শিশু পরিচর্যা কর্মীরা বছরে গড়ে প্রায় ৩৩,১৪০ ডলার আয় করেন।
শিশুদের দেখাশোনার এই সংকট সমাধানে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এটি পরিবারগুলোর ভবিষ্যৎ, দেশের অর্থনীতি এবং কর্মসংস্থানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: সিএনএন