গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ৭৪ জনের বেশি, উদ্বাস্তু হাজারো ফিলিস্তিনি।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর লাগাতার আক্রমণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে নিহত হয়েছেন ৭৪ জনের বেশি ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। এই পরিস্থিতিতে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হচ্ছে।
খান ইউনিসে আবাসিক এলাকাগুলোতে চালানো হামলায় বৃহস্পতিবার ভোর পর্যন্ত অন্তত ৫৭ জন নিহত হয়েছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি হাসান মোকেবল এই হামলাকে বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “গত ১৯ মাস ধরে তারা গাজায় বোমা হামলা চালাচ্ছে। গাজায় আর কী অবশিষ্ট আছে? নিরীহ শিশুরা মারা যাচ্ছে। এখানে কোনো সশস্ত্র তৎপরতা নেই। বৃদ্ধ মানুষগুলো মারা যাচ্ছে।”
নিহতদের মধ্যে ফিলিস্তিনের সাংবাদিক হাসান সামুরও রয়েছেন। খান ইউনুসের পূর্বে বানি সুহাইলা শহরে ইসরায়েলি হামলায় তার পরিবারের আরও কয়েকজন সদস্য নিহত হয়েছেন। এছাড়া, জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নেওয়ার সময় আরেক ফিলিস্তিনি সাংবাদিক হাসান আসলিহ ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় নিহত হন।
সংবাদকর্মীদের সুরক্ষা বিষয়ক কমিটি (সিপিজে)-এর তথ্য অনুযায়ী, ৭ অক্টোবর ২০২৩ সাল থেকে ইসরায়েলি হামলায় ১৭০ জনের বেশি সাংবাদিক ও গণমাধ্যম কর্মী নিহত হয়েছেন। এর ফলে গাজা সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে।
এদিকে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজা শহর থেকে হাজার হাজার মানুষকে সরিয়ে নিতে নতুন করে নির্দেশ জারি করেছে। আতঙ্কে সেখানকার বাসিন্দারা তাদের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছে। আল জাজিরার প্রতিনিধি হানি মাহমুদ জানিয়েছেন, “আমরা দেখছি পরিবারগুলো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে রাস্তায় নামছে। শিশু ও বৃদ্ধরা যা পারছে, তাই নিয়ে যাচ্ছে। তাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও ইসরায়েলি বোমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে।”
পশ্চিম তীরেও সংঘাতের বিস্তার।
গাজায় হামলার পাশাপাশি ইসরায়েলি সরকার অধিকৃত পশ্চিম তীরেও সহিংসতার বিস্তার ঘটানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসরায়েলের চরম ডানপন্থী জোটের প্রভাবশালী সদস্য, অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামগুলো ধ্বংস করার জন্য সামরিক বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। সম্প্রতি পশ্চিম তীরে এক ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীর মৃত্যুর পর তিনি এই মন্তব্য করেন।
বৃহস্পতিবার ভোরে ইসরায়েলি বাহিনী পশ্চিম তীরে অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন শহর ও শরণার্থী শিবিরে হামলা চালায়। নাবলুস, বেথলেহেম, দুরা, কান্ডিয়া, ইয়াবাদ, ফাওয়ার ও আসকার শরণার্থী শিবিরে বাড়িঘরে তল্লাশি, ধরপাকড় ও নির্যাতনের খবর পাওয়া গেছে।
ফিলিস্তিনিদের ‘নাকবা’র 77তম বার্ষিকী।
ফিলিস্তিনিদের ওপর এই সহিংসতা এমন এক সময়ে বাড়ছে, যখন তারা ‘নাকবা’ বা বিপর্যয়ের ৭৭তম বার্ষিকী পালন করছে। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল। ধ্বংস করা হয়েছিল ৫৩০টির বেশি গ্রাম ও শহর। সেই সময় ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ হয় নিহত হয়, না হয় তাদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ইসরায়েল ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ ভূমি দখল করে নেয়।
১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকা ইসরায়েলের দখলে আসে এবং এখনো তারা ইসরায়েলি সামরিক শাসনের অধীনে রয়েছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংস হামলায় প্রায় ৫৩ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
সংঘাতের তীব্রতা বৃদ্ধি এবং মৃতের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মানবাধিকার সংস্থা, গণমাধ্যম স্বাধীনতা বিষয়ক সংগঠন এবং ফিলিস্তিনিরা সতর্ক করে বলেছে, এটি একটি পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞের অংশ। গাজা এবং পশ্চিম তীর উভয় স্থানেই হামলার কারণে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম উদ্বেগে রয়েছে। তাদের আশঙ্কা, তাদের আর কোনো ভূমি অবশিষ্ট থাকবে কিনা।
তথ্য সূত্র: আল জাজিরা