গাজায় ত্রাণ বিতরণের স্থানে সংঘর্ষ, ১ জন নিহত, আহত অর্ধশতাধিক।
গাজা উপত্যকায় একটি নতুন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে অন্তত একজন নিহত এবং আটচল্লিশ জন আহত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বুধবার এই তথ্য জানিয়েছে। এই ত্রাণ কেন্দ্রটি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট একটি সংস্থা স্থাপন করেছে।
মঙ্গলবার, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত এই কেন্দ্রে খাদ্য সংগ্রহের জন্য আসা ফিলিস্তিনিরা যখন প্রবেশপথ ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করে, তখনই এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ইসরায়েলি ট্যাংক ও বন্দুক থেকে গুলি চালানো হয় এবং একটি সামরিক হেলিকপ্টার থেকে ফ্ল্যাশ বোমা নিক্ষেপ করা হয়।
তবে, কারা গুলি চালিয়েছিল – ইসরায়েলি বাহিনী, নাকি বেসরকারি নিরাপত্তা ঠিকাদার, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ত্রাণ সরবরাহকারী সংস্থাটি জানিয়েছে, তাদের নিরাপত্তা ঠিকাদাররা প্রথমে পিছু হটে যায়, পরে আবার ত্রাণ কার্যক্রম শুরু করে। অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে, তাদের সেনারা সতর্কতামূলক গুলি ছুড়েছিল।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক অফিসের ফিলিস্তিন অঞ্চলের প্রধান অজিত সাংহাই জেনেভায় সাংবাদিকদের জানান, আহতদের মধ্যে বেশিরভাগই গুলির শিকার হয়েছেন।
এদিকে, বুধবার পৃথক এক ঘটনায়, ইসরায়েল ইয়েমেনের রাজধানী সানার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে দেশটির জাতীয় পতাকাবাহী বিমানের শেষ উড়োজাহাজটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। সম্প্রতি ইরান সমর্থিত হুতি বিদ্রোহীরা ইসরায়েলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর পরেই এই হামলা চালানো হয়।
যদিও এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা বিদ্রোহীদের ব্যবহৃত উড়োজাহাজ ধ্বংস করেছে। তবে, এই হামলায় কেউ নিহত হয়েছে কিনা, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
গাজায় খাদ্য সংকটের চরম পরিস্থিতি।
গাজায় মানবিক সহায়তা বিতরণের নতুন এই কেন্দ্রটি রাফাহ শহরের কাছে স্থাপন করা হয়েছে। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) নামের একটি সংস্থা এটি পরিচালনা করছে। ইসরায়েল এই সংস্থাকে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দিতে চাইছে।
কিন্তু জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংস্থা এই নতুন পদ্ধতির বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এই ব্যবস্থা গাজার ২৩ লাখ মানুষের চাহিদা মেটাতে পারবে না এবং এর মাধ্যমে ইসরায়েল খাদ্যকে একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সেখানকার জনগণের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এছাড়া, ইসরায়েলি সেনা ও ত্রাণপ্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি নিয়েও তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
ইসরায়েলের অবরোধের কারণে গাজায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেখানকার মানুষ এখন খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রীর জন্য চরমভাবে অসহায় হয়ে পড়েছে। ইসরায়েল বলছে, তারা হামাসকে ত্রাণ সরবরাহ থেকে বিরত রাখতে এই নতুন সহায়তা ব্যবস্থা তৈরি করেছে। যদিও তারা এর কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলোও জানিয়েছে, তাদের কাছে ত্রাণ বিতরণের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে কোনো ধরনের খাদ্য সরবারহে দুর্নীতি না হয়।
জিএইচএফ জানিয়েছে, তারা ইতোমধ্যে চারটি কেন্দ্র স্থাপন করেছে, যার মধ্যে দুটি চালু হয়েছে। এসব কেন্দ্রে বেসরকারি নিরাপত্তা কর্মীদের মোতায়েন করা হয়েছে এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য সামরিক ঘাঁটির মতো লোহার বেড়া দিয়ে ঘেরা স্থান তৈরি করা হয়েছে।
ইসরায়েলি বাহিনী এই কেন্দ্রগুলোর কাছেই অবস্থান করছে। ইসরায়েল এটিকে ‘মোরাক করিডোর’ হিসেবে উল্লেখ করেছে, যা রাফাহ শহরকে উপত্যকার বাকি অংশ থেকে আলাদা করে।
জাতিসংঘ ও অন্যান্য মানবিক সংগঠনগুলো জিএইচএফের এই সিস্টেমে অংশ নিতে রাজি হয়নি। তাদের মতে, এটি মানবিক নীতিমালার পরিপন্থী। তাদের আশঙ্কা, ইসরায়েল এর মাধ্যমে গাজার বাসিন্দাদের বিতরণের কেন্দ্রগুলোর কাছে যেতে বাধ্য করতে পারে, অন্যথায় তারা অনাহারে মারা যাবে।
এটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু মঙ্গলবার বলেছেন, ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে ‘কিছুটা নিয়ন্ত্রণহীনতা’ দেখা গিয়েছিল, তবে ‘আমরা তা নিয়ন্ত্রণে এনেছি’। তিনি আবারও জানান, ইসরায়েল গাজার পুরো জনসংখ্যাকে উপত্যকার দক্ষিণে একটি ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ সরিয়ে নিতে চায়, যেখানে সৈন্যরা হামাসের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবে।
জাতিসংঘ এবং অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো দীর্ঘদিন ধরে গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রী বিতরণের কাজ করে আসছে। ইসরায়েল বলছে, জিএইচএফ এই নেটওয়ার্কের স্থলাভিষিক্ত হবে। তবে, গত এক সপ্তাহে জাতিসংঘের মাধ্যমে সামান্য কিছু ত্রাণ প্রবেশ করতে দেখা গেছে।
ইসরায়েল জানিয়েছে, তারা হুতিদের শেষ বিমানটি ধ্বংস করেছে।
ইয়েমেনের বিমানবন্দরে ইসরায়েলি হামলায় দেশটির জাতীয় পতাকাবাহী বিমান সংস্থা ইয়েমেনিয়ার শেষ বিমানটিও ধ্বংস হয়ে গেছে। বিমান ট্র্যাকিং ওয়েবসাইট ফ্লাইটরাডার২৪ অনুসারে, ইয়েমেনিয়া’র মোট চারটি বিমান ছিল।
এর মধ্যে তিনটি বিমান গত ৬ মে বিমানবন্দরের উপর চালানো এক হামলায় ধ্বংস হয়ে যায়। বুধবার বিমানবন্দরের প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, একটি ইয়েমেনিয়ার বিমান রানওয়ের উপর দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে এবং তা থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজরায়েল কাটস বলেছেন, বুধবারের হামলায় হুতিদের ব্যবহৃত শেষ বিমানটিও ধ্বংস করা হয়েছে।
গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই হুতি বিদ্রোহীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের উপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এর ফলে তারা দেশে ও আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করেছে।
হুতি বিদ্রোহীদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা সাধারণত প্রতিহত করা হয়, তবে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করতে সক্ষম হয়েছে, যার ফলে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলও প্রায়ই ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের উপর, বিশেষ করে কৌশলগত বন্দর হোদেইদার আশেপাশে পাল্টা হামলা চালিয়েছে।
নেতানিয়াহু বলেছেন, হুতিরা যদি ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা অব্যাহত রাখে, তাহলে ইসরায়েলও হামলা চালিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ‘যারা শক্তি বোঝে না, তারা আরও বেশি শক্তি অনুভব করবে’।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে হামলা চালিয়ে প্রায় ১,২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে অপহরণ করে। হামাসের হাতে এখনো ৫৮ জন জিম্মি রয়েছে, যাদের এক তৃতীয়াংশ জীবিত আছে বলে ধারণা করা হয়।
ইসরায়েলি বাহিনী আটজনকে উদ্ধার করেছে এবং অনেকের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলের প্রতিশোধমূলক হামলায় এখন পর্যন্ত ৫৪,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যাই বেশি।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিহতদের মধ্যে বেসামরিক ও যোদ্ধাদের পৃথক হিসাব দেয়নি।
তথ্য সূত্র: এসোসিয়েটেড প্রেস