যুদ্ধ যখন এক কোটি ছাড়িয়েছে: ইউক্রেনে রাশিয়ার ক্ষয়ক্ষতি
কিয়েভ থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর হতাহতের সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ইউক্রেনীয় সামরিক কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বৃহস্পতিবার এই তথ্য জানানো হয়েছে। তাঁদের মতে, তিন বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে মস্কোকে বিশাল মূল্য দিতে হচ্ছে।
ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফের দেওয়া এই তথ্য পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থার অনুমানের সঙ্গে মিলে যায়। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রাশিয়া ইতোমধ্যেই ১০ লাখেরও বেশি সেনা হতাহতের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে গত বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া পূর্ণমাত্রার অভিযানে প্রায় আড়াই লাখ সেনা নিহত হয়েছে।
ওয়াশিংটনের সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (Center for Strategic and International Studies) গত ৩ জুন জানায়, রাশিয়া সম্ভবত এই গ্রীষ্মেই ১০ লাখ হতাহতের মাইলফলক স্পর্শ করবে। এটিকে তারা “ভয়ঙ্কর ও মর্মান্তিক ঘটনা” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
যুদ্ধ শুরুর দিকে রাশিয়া তাদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে সামান্য তথ্য জানিয়েছিল। সে সময় তারা জানিয়েছিল, প্রায় ৬ হাজার সেনা নিহত হয়েছে। যদিও পরে তারা ইউক্রেনীয় সেনাদের ক্ষতির পরিমাণ ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি সবশেষ ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে কথা বলেছিলেন। সেই সময় তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, তাঁদের দেশের ৪৫ হাজার ১০০ সেনা নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ৩ লাখ ৯০ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। তবে উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতির এই হিসাব নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
এদিকে, আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও রাশিয়া ইউক্রেনে ড্রোন ও অন্যান্য অস্ত্র দিয়ে হামলা অব্যাহত রেখেছে। এর ফলে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের ঘটনা ঘটছে। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনীর তথ্যমতে, বৃহস্পতিবার রাতে রাশিয়া ৬৩টি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। এর মধ্যে ২৮টি ড্রোন ধ্বংস করা হয়েছে এবং ২১টিকে অকার্যকর করা হয়েছে।
ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় দোনেৎস্ক অঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় ২ জন নিহত এবং ৬ জন আহত হয়েছে বলে ইউক্রেনীয় পুলিশ জানিয়েছে। এই অঞ্চলের পরিস্থিতি বর্তমানে বেশ উদ্বেগজনক। এছাড়া, দক্ষিণাঞ্চলীয় খেরসন অঞ্চলে, যা আংশিকভাবে রাশিয়ার দখলে রয়েছে, সেখানে ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত হয়েছে।
ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে রাশিয়ার ড্রোন হামলায় ১৮ জন আহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ৪ জন শিশুও রয়েছে। খারকিভের মেয়র ইগর তেরেখভ জানিয়েছেন, আবাসিক এলাকা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কিন্ডারগার্টেন এবং অন্যান্য বেসামরিক অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। মেয়র আরও বলেন, “খারকিভ টিকে আছে। মানুষজন বেঁচে আছে। এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে রাশিয়া দফায় দফায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাচ্ছে। গত সোমবার প্রায় ৫০০ ড্রোন দিয়ে নজিরবিহীন হামলা চালানো হয়। মঙ্গলবার রাতেও চালানো হয় ৩১৫টি ড্রোন ও ৭টি ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা।
অন্যদিকে, ইউক্রেনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ড্রোন হামলা চালিয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার ভোরে তারা ইউক্রেনের ৫২টি ড্রোন ভূপাতিত করেছে, যার মধ্যে ৪১টি বেলগোরোদ অঞ্চলের ওপর দিয়ে যাচ্ছিল।
যুদ্ধবিরতির আলোচনার মধ্যেই উভয়পক্ষের মধ্যে এই আক্রমণাত্মক তৎপরতা চলছে। ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত আলোচনায় রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যায়। উভয় পক্ষই একে অপরের শর্ত মানতে নারাজ হওয়ায় দ্রুত কোনো সমাধানে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে।
আলোচনার ফলস্বরূপ, রাশিয়া ও ইউক্রেন আবারও যুদ্ধবন্দী ও নিহত সেনাদের মরদেহ বিনিময় করতে সম্মত হয়েছে। জেলেনস্কি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “আমাদের সেনারা ঘরে ফিরছেন। তাঁদের সকলের চিকিৎসার প্রয়োজন এবং তাঁরা প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। গুরুতর আহত ও অসুস্থদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় পদক্ষেপ।”
ইউক্রেনের মানবাধিকার বিষয়ক ombudsman দিমিত্রো লুবিনেটস জানিয়েছেন, ফেরত আসা সেনাদের মধ্যে কয়েকজনকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিখোঁজ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বয়সী হলেন ৫৯ বছর এবং কনিষ্ঠতমের বয়স ২২ বছর।
এদিকে, ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শান্তি আলোচনার উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। তবে তিনি রুশ আলোচক হিসেবে ভ্লাদিমির মেদিনস্কিকে নিয়োগের সমালোচনা করেন। রুটে বলেন, “রাশিয়ানরা যখন ১০০০ বছর আগের ইতিহাস টেনে এনে ইউক্রেনকে দোষারোপ করে, তখন আলোচনা ফলপ্রসূ হয় না।”
অন্যদিকে, জার্মানির প্রতিরক্ষামন্ত্রী বরিস পিস্টোরিয়াস এক অপ্রত্যাশিত সফরে কিয়েভে পৌঁছেছেন। তিনি জানান, রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলাগুলো শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের আগ্রহের অভাবের প্রমাণ। পিস্টোরিয়াস আরও বলেন, জার্মানি ইউক্রেনের পাশে আছে এবং ভবিষ্যতে জার্মানি ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলো কীভাবে সহযোগিতা করবে, সে বিষয়ে আলোচনা হবে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস