প্যারিসের এক বিস্ময়কর ইতিহাস, যেখানে পর্যটকেরা ভিড় জমাতেন—কিন্তু কিসের টানে?
ফরাসি বিপ্লবের পর প্যারিস যখন নতুন করে সাজছে, সেই সময়কার কথা। শহরজুড়ে উন্নয়নের ছোঁয়া, ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, আর মানুষের জীবনযাত্রায় আধুনিকতার ছোঁয়া।
তবে, এই পরিবর্তনের মাঝেও লুকিয়ে ছিল এক অদ্ভুত আকর্ষণ, যা আজও আমাদের কৌতূহলী করে তোলে। ঘটনাটি উনিশ শতকের প্যারিসের, যখন পর্যটকদের প্রধান আকর্ষন ছিল—লা মর্গ দে প্যারিস, বা প্যারিসের মর্গে ভিড় করা।
মর্গ, যেখানে শহরের পরিচয়হীন মৃতদেহগুলি রাখা হতো। প্রথমে এর উদ্দেশ্য ছিল, মৃত ব্যক্তিদের সনাক্ত করা।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এটি পরিণত হয় এক অদ্ভুত দর্শনীয় স্থানে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসতেন, কফিনবন্দী মৃতদেহগুলো দেখতে।
কাঁচের দেয়ালের ওপাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হতো মৃতদেহগুলো। তাদের পরনে হয়তো ছিল না কোনো পোশাক, অথবা হয়তো তাদের পরিধেয় বস্ত্রগুলো ঝুলিয়ে রাখা হতো দেহের পাশে। যেন এক নীরব প্রদর্শনী!
ব্যাপারটা এমন ছিল না যে, সবাই শোকাহত হয়ে আসতেন। বরং, অনেক ক্ষেত্রে কৌতূহল ছিল প্রধান বিষয়।
সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি, এমনকি সাহিত্যিকরাও আসতেন এই মর্গে। চার্লস ডিকেন্সের মতো বিখ্যাত লেখকও একাধিকবার গিয়েছিলেন সেখানে। এমিল জোলা তাঁর লেখায় এই মর্গের কথা উল্লেখ করেছেন, যা সমাজের কদর্য রূপ ফুটিয়ে তোলে।
এই মর্গ তৈরির মূল কারণ ছিল, অজ্ঞাতপরিচয় মৃতদেহগুলোর পরিচয় নিশ্চিত করা। ১৮০০-এর দশকে প্যারিসের জনসংখ্যা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। এর সাথে বাড়ে পরিচয়হীন মৃত্যুর সংখ্যাও।
কারণ, তখন মৃতদেহ শনাক্ত করার তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে, শহরের কর্তৃপক্ষ এই সমস্যার সমাধানে একটি মর্গ তৈরি করে।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর চরিত্র বদলাতে শুরু করে। উন্নত কাঁচের ব্যবহার, মৃতদেহ সংরক্ষণে নতুন প্রযুক্তি—এগুলো মর্গের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়।
সংবাদপত্রে মর্গের বিভিন্ন ঘটনার সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে শুরু করে। ফলে, সাধারণ মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে আগ্রহ আরও বাড়ে।
যেন এক বাস্তব ‘ক্রাইম থ্রিলার’-এর সাক্ষী হতে আসতেন তারা।
প্যারিসের এই মর্গ শুধু একটি দর্শনীয় স্থান ছিল না, এটি ফরেনসিক বিজ্ঞান এবং আধুনিক পুলিশিং-এর ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
প্যারিসের এই মর্গের ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বিশ্বের বিভিন্ন শহরেও অনুরূপ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। নিউ ইয়র্ক, সান ফ্রান্সিসকো, বার্লিন, এমনকি বুখারেস্টেও এই ধরনের মর্গ তৈরি করা হয়েছিল।
১৯০৭ সালে প্যারিসের মর্গটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর মানুষের রুচি এবং আগ্রহের ধরনে পরিবর্তন আসে।
তবে, মানুষের মধ্যে রহস্য আর কৌতূহলের যে ক্ষুধা, তা আজও বিদ্যমান। আজকের দিনেও আমরা দেখি, কীভাবে মানুষ বিভিন্ন অপরাধ বিষয়ক ঘটনা নিয়ে আগ্রহী হয়।
প্যারিসের এই মর্গের গল্প, আমাদের সমাজের একটি বিশেষ দিক উন্মোচন করে। এটি আমাদের জানায়, কীভাবে মানুষ কৌতূহল থেকে তথ্যের সন্ধানে ছুটে যায়, এবং কীভাবে ট্র্যাজেডিকেও অনেক সময় বিনোদনের একটি অংশে পরিণত করা হয়।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক