ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে ইসরায়েলের হামলা: উত্তেজনা তুঙ্গে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নতুন করে বাড়ছে। সম্প্রতি, ইসরায়েল ইরানের বিভিন্ন পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, শুক্রবার (তারিখ উল্লেখ করা হয়নি) এই হামলা চালানো হয়। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ইরান পরমাণু বোমা তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাওয়ায় এই হামলা ছিল তাদের আত্মরক্ষামূলক পদক্ষেপ। তবে, তেহরান বরাবরই তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে আসছে।
এই ঘটনার কয়েক দিন আগে, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা না করার কারণে দেশটির সমালোচনা করে। গত ২০ বছরে এই প্রথমবার এমন ঘটনা ঘটল। এরপর ইরান দ্রুত দেশের অভ্যন্তরে তৃতীয় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দেয় এবং পুরোনো কিছু সেন্ট্রিফিউজের বদলে আধুনিক সরঞ্জাম বসানোর কথা জানায়।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে একটি সমঝোতা আলোচনার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, যেখানে তেহরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া সীমিত করার বিনিময়ে ইরানের উপর থেকে মার্কিন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু ইসরায়েলের এই হামলার ফলে সেই আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিয়েছে।
আসুন, ইরানের প্রধান কিছু পারমাণবিক কেন্দ্র এবং সেগুলোর গুরুত্ব সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক:
১. নাতানজ সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র:
তেহরান থেকে প্রায় ২২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত নাতানজ ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র। এই কেন্দ্রের কিছু অংশ মাটির নিচে তৈরি করা হয়েছে, যা সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
এখানে একাধিক সেন্ট্রিফিউজের সমন্বয়ে গঠিত ‘ক্যাসকেড’ ব্যবহার করা হয়, যা দ্রুত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সহায়ক। নাতানজের কাছে ‘কোহ-ই-কোলং গাজ লা’ নামক একটি স্থানেও খননকার্য চলছে। শোনা যায়, এই কেন্দ্রে আগে ‘স্টাক্সনেট’ ভাইরাস দ্বারা আক্রমণ করা হয়েছিল, যা ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়।
এছাড়াও, এই কেন্দ্রে বেশ কয়েকবার নাশকতা চালানো হয়েছে, যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করা হয়।
২. ফোরদো সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র:
ফোরদো কেন্দ্রটি তেহরান থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটিও সেন্ট্রিফিউজ সমৃদ্ধ একটি কেন্দ্র, তবে নাতানজের তুলনায় এর আয়তন ছোট।
এটি একটি পাহাড়ের নিচে নির্মিত এবং বিমান হামলা থেকে বাঁচানোর জন্য অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট ব্যাটারির মাধ্যমে সুরক্ষিত। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল।
তবে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা মিত্রদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানতে পারার পর, ইরান ২০০৯ সালে জাতিসংঘের পরমাণু পর্যবেক্ষকদের এই কেন্দ্রের বিষয়ে অবহিত করে।
৩. বুশেহর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র:
ফার্সি উপসাগরের তীরে অবস্থিত বুশেহর ইরানের একমাত্র বাণিজ্যিক পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এটি তেহরান থেকে প্রায় ৭৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত।
১৯৭০-এর দশকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির শাসনামলে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর ইরান-ইরাক যুদ্ধে এটি বেশ কয়েকবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পরে রাশিয়া এই কেন্দ্রের নির্মাণ সম্পন্ন করে। বুশেহরে আরও দুটি চুল্লি নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এই কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ইউরেনিয়াম রাশিয়া থেকে সরবরাহ করা হয় এবং জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) এটি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে।
৪. আরাক ভারী পানির চুল্লি:
আরাক ভারী পানির চুল্লি তেহরান থেকে ২৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। ভারী পানি পারমাণবিক চুল্লিকে ঠান্ডা রাখতে ব্যবহৃত হয়।
তবে, এর উপজাত হিসেবে প্লুটোনিয়াম তৈরি হয়, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ২০১৫ সালের পরমাণু চুক্তিতে ইরান এই কেন্দ্রটিকে নতুন করে ডিজাইন করতে রাজি হয়েছিল, যাতে এর অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা কমানো যায়।
৫. ইসফাহান পারমাণবিক প্রযুক্তি কেন্দ্র:
তেহরান থেকে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত ইসফাহান কেন্দ্রে হাজার হাজার পরমাণু বিজ্ঞানী কাজ করেন। এখানে তিনটি চীনা গবেষণা চুল্লি এবং দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন পরীক্ষাগার রয়েছে।
৬. তেহরান গবেষণা চুল্লি:
তেহরান গবেষণা চুল্লিটি ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার সদর দফতরে অবস্থিত। ১৯৬৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এই চুল্লিটি ইরানকে দেওয়া হয়েছিল।
শুরুতে এখানে উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম ব্যবহার করা হলেও, পরে তা কম সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামে পরিবর্তন করা হয়।
ইসরায়েলের এই হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন এই অঞ্চলের পরিস্থিতি কিভাবে সামাল দেয়, সেদিকে তাকিয়ে আছে।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস