ইরানে ইসরায়েলের বড় ধরনের হামলা, মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা।
জেরুজালেম, শুক্রবার, ইসরায়েল ইরানের ওপর একটি বড় ধরনের সামরিক হামলা চালিয়েছে। এর মাধ্যমে দেশ দুটি দীর্ঘদিন ধরে যে ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল, সেটি এবার একটি সরাসরি এবং ভয়ঙ্কর রূপ নিতে পারে, যা বৃহত্তর আঞ্চলিক যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
শুক্রবার তেহরানে বেশ কয়েকটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা ইরানের পারমাণবিক এবং সামরিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হেনেছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, দেশটির আধা-সামরিক বিপ্লবী গার্ডের প্রধান, ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির প্রধান এবং শীর্ষস্থানীয় দুজন পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল আরও কয়েকজন বিপ্লবী গার্ড সদস্যকে হত্যার দাবি করেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের ওপর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান একশর বেশি ড্রোন হামলা চালায়। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা এর বেশিরভাগই আকাশেই প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছে। শুক্রবার দুপুরের পর পর্যন্ত ইরানের অভ্যন্তরে হামলা অব্যাহত ছিল বলে জানা গেছে।
ইরানের দ্রুত অগ্রসরমান পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলের এই হামলা হয়। ইসরায়েল মনে করে, ইরানের এই কর্মসূচি তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি স্বরূপ।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণে সীমা নির্ধারণের বিনিময়ে দেশটির ওপর থেকে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছিল। তবে, মার্কিন ও ইরানি কূটনীতিকদের মধ্যে হওয়া এই পরোক্ষ আলোচনা বর্তমানে অচলাবস্থায় রয়েছে।
ইসরায়েলের এই হামলার ফলে পুরো অঞ্চলে নতুন ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আসুন, এই হামলা সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জেনে নেওয়া যাক:
**পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত, বিপ্লবী গার্ড প্রধান নিহত**
ইসরায়েলি নেতারা জানিয়েছেন, এই হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে বাধা দেওয়া। কারণ, দেশটি দ্রুতগতিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় মাত্রার খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যদিও ইরান দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তবে, যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নিশ্চিত করেছে যে ইরান বর্তমানে কোনো বোমা তৈরি করছে না।
সামরিক অভিযান ঘোষণার এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, তারা ইরানের প্রধান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে এবং দেশটির শীর্ষস্থানীয় পরমাণু বিজ্ঞানীদেরও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। এছাড়াও, ইসরায়েল ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ভাণ্ডারেও আঘাত হেনেছে।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানায়, ইরানের বিপ্লবী গার্ডের প্রধান এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার জেনারেল হোসেন সালামি এবং বিপ্লবী গার্ডের ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচির প্রধান জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল আরও জানিয়েছে, তারা অন্য দুইজন শীর্ষ কর্মকর্তাকেও হত্যা করেছে, যারা একটি ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে অবস্থান করছিলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ইসরায়েল এখনো ইরানের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালাচ্ছে। তবে, তিনি নির্দিষ্ট স্থানগুলোর কথা বলতে রাজি হননি।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন এবং ফার্স নিউজ এজেন্সি উভয়েই নাতানজে ইসরায়েলের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার খবর প্রকাশ করেছে। এছাড়াও, তারা শিরাজ ও তাবরিজে হামলার খবরও প্রচার করেছে।
**ড্রোন হামলা, তবে ইসরায়েলের প্রতিরোধ**
এর প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরায়েলের দিকে একশর বেশি ড্রোন পাঠায়।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ড্রোনগুলোর বেশিরভাগই ভূপাতিত করতে সক্ষম হয়েছে। একইসঙ্গে তারা জনগণকে আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করার অনুমতি দেয়। তবে, সামরিক বাহিনী এখনো সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে এবং দেশের সীমান্ত রক্ষার জন্য হাজার হাজার সৈন্যকে তলব করেছে। ইসরায়েলের আকাশসীমা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেছেন, ইসরায়েলের এই হামলার কঠোর জবাব দেওয়া হবে।
ওয়াশিংটন থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেন, ইসরায়েলের হামলা ‘আরও খারাপের দিকে যাবে’। এর আগে তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই হামলায় জড়িত ছিল না।
**সামরিক অভিযান: ইসরায়েলের বিমান বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা**
একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রায় ২০০টি বিমান একসঙ্গে আকাশে ওড়ে ইরানের অভ্যন্তরে ২,০০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে অভিযান পরিচালনা করে। তাদের লক্ষ্য ছিল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির স্থান এবং ইসরায়েলের দিকে ছোড়ার জন্য প্রস্তুত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, কয়েক ডজন রাডার স্থাপনাসহ ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা হয়েছে।
এই অভিযানে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদও জড়িত ছিল। ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানান, শুক্রবারের হামলার আগে মোসাদ ইরানের অভ্যন্তরে অস্ত্র সরবরাহ করে, যা তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করে ব্যবহারের জন্য কাজে লাগানো হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুইজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা শুক্রবার অত্যন্ত গোপন এই অভিযানের বিষয়ে কথা বলেন। তাদের দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
কর্মকর্তারা জানান, ইরানের অভ্যন্তরে বিস্ফোরক ড্রোন উৎক্ষেপণের জন্য একটি ঘাঁটি স্থাপন করা হয়েছে এবং শুক্রবারের হামলায় তেহরানের কাছে একটি ইরানি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণকারী যন্ত্রাংশকে লক্ষ্য করে ড্রোনগুলো সক্রিয় করা হয়।
তাছাড়া, ইসরায়েল মধ্য ইরানের অভ্যন্তরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এমন অস্ত্র সরবরাহ করেছে এবং সেগুলোকে ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার কাছে স্থাপন করেছে। একইসঙ্গে তারা গাড়িতে করে আঘাত হানতে সক্ষম এমন ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলার শুরুতে ইরানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা লক্ষ্য করে এই দুটি ব্যবস্থাই সক্রিয় করা হয়। তবে, এ বিষয়ে কোনো সরকারি মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
**বোমা তৈরির কতটা কাছাকাছি ইরান?**
শুক্রবার নেতানিয়াহু দাবি করেন, ইরানকে যদি এখনই প্রতিহত করা না যায়, তবে ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তারা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে পারবে’। তবে, ইরান যদি বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে সম্ভবত এটি তৈরি করতে তাদের কয়েক মাস সময় লাগবে। এছাড়াও, ক্ষেপণাস্ত্রের মাথায় বসানোর জন্য বোমা ছোট করার মতো প্রযুক্তি তাদের আছে কিনা, তা এখনো প্রমাণিত হয়নি।
ইরানি কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বোমা তৈরির হুমকি দিয়েছেন। ইরানের দ্রুত পারমাণবিক অগ্রগতি এবং উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুদ বৃদ্ধি নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে। এর সাত বছর আগে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে ইরানের সঙ্গে ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
গত দুই দশকে এই প্রথম আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) ইরানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে বাধা দেওয়ার উদ্দেশ্যে করা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ সংক্রান্ত বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে।
জবাবে ইরান জানায়, তারা পূর্বে গোপন রাখা একটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র চালু করবে এবং ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন আরও বাড়াবে, যা সহজেই ৯০ শতাংশ মাত্রায় উন্নীত করা যেতে পারে, যা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
**ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো: উদ্বেগের কারণ**
ইরানের প্রধান দুটি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র হলো: দেশটির মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত নাতানজ এবং তেহরানের প্রায় ৯০ কিলোমিটার (৫৫ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে কোমের কাছে অবস্থিত ফোরদো।
উভয় কেন্দ্রই সম্ভাব্য বিমান হামলা থেকে রক্ষার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। নাতানজ ইরানের কেন্দ্রীয় মালভূমিতে ভূগর্ভে নির্মিত হয়েছে এবং এর আগে একাধিকবার সন্দেহজনক ইসরায়েলি নাশকতা হামলার শিকার হয়েছে। এছাড়াও, এটি স্টাক্সনেট ভাইরাসের শিকার হয়েছিল, যা সম্ভবত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি ভাইরাস ছিল এবং এর মাধ্যমে ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলো ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
ফোরদো একটি পাহাড়ের গভীরে অবস্থিত এবং বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সুরক্ষিত। এখানেও সেন্ট্রিফিউজের ধারা রয়েছে, তবে এটি নাতানজের মতো বড় নয়।
ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে তেহরানের সঙ্গে একটি নতুন পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য এই দুটি স্থানকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছিল। ট্রাম্প জানান, কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলমান থাকা অবস্থায় তিনি নেতানিয়াহুকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা না করার জন্য সতর্ক করেছিলেন।
মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ রবিবার ওমানে তাঁর ইরানি প্রতিপক্ষের সঙ্গে ষষ্ঠ দফা আলোচনার জন্য মিলিত হওয়ার কথা ছিল। তবে, এই হামলাগুলোর পর সেই আলোচনা হবে কিনা, অথবা আলোচনা পুনরায় শুরু হবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস।