**ইসরায়েল-ইরান সংঘাত: পারমাণবিক আলোচনা স্থগিত, উভয়পক্ষে হতাহত**

মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা আরও বাড়ছে, কারণ ইসরায়েল এবং ইরানের মধ্যে প্রতিশোধমূলক হামলা অব্যাহত রয়েছে। রবিবার তৃতীয় দিনের মতো ইরান জুড়ে ইসরায়েলি বিমান হামলা হয়েছে, যার ফলস্বরূপ উভয় দেশেই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

একইসঙ্গে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার পরিকল্পনাও বাতিল করা হয়েছে।

সংবাদ সংস্থা এপির খবর অনুযায়ী, শুক্রবার ইসরায়েলের বোমা হামলায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় বেশ কয়েকজন শীর্ষ জেনারেল এবং বিজ্ঞানী নিহত হওয়ার পর এই অঞ্চলের পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে।

উভয় পক্ষই কোনো রকম পিছু হটতে রাজি নয়। ইরান দাবি করেছে, ইসরায়েল তাদের দুটি তেল শোধনাগারে আঘাত হেনেছে, যা দেশটির ওপর আরও বৃহত্তর আক্রমণের আশঙ্কা তৈরি করেছে।

এর ফলে বিশ্ব বাজারে তেলের দামে প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তাদের সামাজিক মাধ্যমে ইরানের নাগরিকদের অস্ত্র কারখানাগুলো খালি করার জন্য সতর্ক করেছে, যা এই অভিযানের আরও বিস্তৃতির ইঙ্গিত দেয়।

অন্যদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরায়েলের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন এবং ইরানকে নতুন পারমাণবিক চুক্তিতে রাজি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, অন্যথায় আরও ধ্বংসযজ্ঞের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা বন্ধ হলে তাদেরও জবাব দেওয়া বন্ধ হবে।

রবিবার ভোরে তেহরানে আবারও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।

এর আগের দিন ইরানের জাতিসংঘে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জানিয়েছিলেন, হামলায় অন্তত ৭৮ জন নিহত এবং ৩২০ জনের বেশি আহত হয়েছে।

ইসরায়েলেও ইরানের হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছে, যা দেশটির মোট মৃতের সংখ্যা ১৩-তে নিয়ে গেছে।

দেশটির প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং আকাশপথও তৃতীয় দিনের মতো বন্ধ রয়েছে।

রবিবার ভোরে ইসরায়েল ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সামরিক ঘাঁটি ও পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে জড়িত স্থানগুলোতে আঘাত হানে।

ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা ইরানের শীর্ষ পর্যায়ে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে, যা শীর্ষস্থানীয় জেনারেল এবং বিজ্ঞানীদের হত্যার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে।

ইসরায়েলের বাত ইয়াম শহরে একটি অ্যাপার্টমেন্টে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানলে ১০ বছর বয়সী শিশুসহ অন্তত ৬ জন নিহত হয়।

স্থানীয় পুলিশ কমান্ডার ড্যানিয়েল হাদ্দাদ জানিয়েছেন, এতে ১৮০ জন আহত হয়েছে এবং সাতজন এখনও নিখোঁজ।

এছাড়াও, উত্তর ইসরায়েলের তামরা শহরে একটি ভবনে ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানলে ১৩ বছর বয়সী এক শিশুসহ আরও চারজন নিহত হয় এবং ২৪ জন আহত হয়।

রেহোভোতের ওয়েইজম্যান বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে কয়েকটি ভবনে আঘাত হানা হলেও কেউ হতাহত হয়নি।

ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা উন্নত হলেও তারা এখনো পুরোপুরি নির্ভুল নয়।

বিশ্ব নেতারা দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা একটি “বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত” স্থাপন করেছে।

গাজায় হামাসকে নির্মূল করতে ইসরায়েলের অভিযান এখনো চলমান থাকায় পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলা “ভবিষ্যতে তাদের অনুভূতির তুলনায় কিছুই নয়”।

মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র এবং অঘোষিত পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ইসরায়েল, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি প্রতিরোধের জন্য এই হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছে।

ইরান বরাবরই বলে আসছে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশগুলোও মনে করে, দেশটি ২০০৩ সালের পর থেকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা করেনি।

তবে তারা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে একাধিক অস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে।

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থা গত সপ্তাহে ইরানের বিরুদ্ধে তাদের বাধ্যবাধকতা মেনে না চলার জন্য নিন্দা জানিয়েছে।

ইরানের শীর্ষ কূটনীতিক আরাকচি বলেছেন, ইসরায়েল তেহরানের কাছে একটি তেল শোধনাগার এবং পারস্য উপসাগরের বুশেহর প্রদেশের আরেকটি শোধনাগারকে লক্ষ্যবস্তু করেছে।

তিনি আরও জানান, ইরান ইসরায়েলের “অর্থনৈতিক” স্থানগুলোতেও আঘাত হেনেছে, তবে বিস্তারিত কিছু জানাননি।

এদিকে, সেমি-অফিসিয়াল ইরানি সংবাদ সংস্থাগুলোর খবর অনুযায়ী, একটি ইসরায়েলি ড্রোন হামলায় ইরানের একটি প্রাকৃতিক গ্যাস প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্রে “বড় ধরনের বিস্ফোরণ” হয়েছে।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য করেনি।

দক্ষিণ পার্স গ্যাস ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।

এই ধরনের স্থানে বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে, যেগুলোকে ইসরায়েল লক্ষ্যবস্তু করছে।

ওমান, যারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের মধ্যে আলোচনায় মধ্যস্থতা করছে, জানিয়েছে রবিবার ষষ্ঠ দফা আলোচনা হওয়ার কথা থাকলেও তা স্থগিত করা হয়েছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, “আমরা আলোচনার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আশা করি ইরান খুব শীঘ্রই আলোচনা টেবিলে বসবে।”

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরাকচি বলেছেন, ইসরায়েলের হামলা “যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তার ফলস্বরূপ”।

সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রবিবার সকালে এক টুইট বার্তায় বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত নয় এবং এর প্রতিশোধ নিলে “আগে কখনো দেখা যায়নি এমন পর্যায়ে” প্রতিক্রিয়া জানানো হবে।

তিনি আরও যোগ করেন, “তবে, আমরা ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি চুক্তি করতে পারি এবং এই রক্তাক্ত সংঘাত শেষ করতে পারি!!!”

স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া ছবি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ইরানের প্রধান পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র নাতানজে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

এই ছবিগুলোতে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে।

এর মধ্যে এমন কিছু কাঠামো রয়েছে যা এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে।

জাতিসংঘের পারমাণবিক প্রধান রাফায়েল গ্রোসি নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, নাতানজ কেন্দ্রের উপরের অংশটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

ভূগর্ভস্থ প্রধান কেন্দ্রটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তবে বিদ্যুতের অভাবে সেখানকার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ইসরায়েল ইসফাহানে একটি পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রেও আঘাত হেনেছে।

আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (IAEA) জানিয়েছে, চারটি “গুরুত্বপূর্ণ ভবন” ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ইউরেনিয়াম রূপান্তর সুবিধাও রয়েছে।

তবে নাতানজ বা ইসফাহানে বিকিরণের মাত্রা বাড়েনি।

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, সেনাবাহিনীর প্রাথমিক মূল্যায়ন অনুসারে নাতানজ এবং ইসফাহানের পারমাণবিক স্থানগুলোর ক্ষতি মেরামত করতে “কয়েক সপ্তাহের বেশি সময়” লাগবে।

ওই কর্মকর্তা আরও জানান, তাদের কাছে ” concrete intelligence ছিল যে ইসফাহানের উৎপাদন সামরিক উদ্দেশ্যে ছিল।”

তথ্য সূত্র: অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস