চীনের নৌ-শক্তির বিস্তার: প্রশান্ত মহাসাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠাচ্ছে চীন, বাড়ছে উদ্বেগ।
গত এক মাস ধরে, চীন তাদের সামরিক শক্তি প্রদর্শনে আরও একধাপ এগিয়েছে। দেশটির যুদ্ধজাহাজগুলো এখন চীনের উপকূল থেকে অনেক দূরে, প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, বেইজিং এই পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বকে তাদের ক্রমবর্ধমান নৌ-সামরিক সক্ষমতার জানান দিচ্ছে। চীনের এই সামরিক তৎপরতা আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
মে মাসের শুরু থেকে, চীনের নৌবহর ‘শ্যান্ডং’ নামক একটি বিমানবাহী রণতরীর নেতৃত্বে ফিলিপাইনের উত্তরে মহড়া চালাচ্ছে। এছাড়া, নতুন বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’ কোরিয়া উপদ্বীপের পশ্চিমে বিতর্কিত জলসীমায় সমুদ্র পরীক্ষা চালাচ্ছে।
চীনের পুরনো বিমানবাহী রণতরী ‘লিয়াওনিং’ জাপানের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে টহল দিচ্ছে।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, ‘ফুজিয়ান’ প্রথমবারের মতো সমুদ্রে অত্যাধুনিক ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ক্যাটাপাল্ট সিস্টেম (Electromagnetic Catapult System) ব্যবহার করে যুদ্ধবিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করিয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর নতুন জাহাজ ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ডের পরেই ‘ফুজিয়ান’-এর স্থান।
জাপান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত সপ্তাহে ‘শ্যান্ডং’ এবং এর সহযোগী জাহাজগুলো ওকিনাওয়া প্রদেশের দক্ষিণে অবস্থিত মিয়াকো দ্বীপের কাছে মহড়া চালিয়েছে। এর ফলে, প্রথমবারের মতো চীনের দুটি বিমানবাহী রণতরী একইসঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরে দেখা গেছে।
চীনের এই সামরিক তৎপরতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে তাইওয়ান। তাইওয়ানকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করে চীন।
তাইওয়ানকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কথাও জানিয়েছে বেইজিং।
বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সামরিক মহড়াগুলো এমন কিছু এলাকার ওপর দিয়ে গেছে, যে পথে তাইওয়ানের প্রতি সমর্থন জানাতে যুক্তরাষ্ট্র নৌ-বহর পাঠাতে পারে। তাইওয়ানের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মে মাসে চীনের নৌবাহিনী প্রায় ৭০টি যুদ্ধজাহাজ এবং উপকূলরক্ষী জাহাজ মোতায়েন করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, চীনের এই শক্তি প্রদর্শনের মূল উদ্দেশ্য হলো নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এবং বিতর্কিত দ্বীপ ও সমুদ্র অঞ্চলের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা।
এর মধ্যে রয়েছে জাপান নিয়ন্ত্রিত সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ (চীন যাদের দিয়াওইউ দ্বীপপুঞ্জ বলে) এবং দক্ষিণ চীন সাগরের বিভিন্ন দ্বীপ।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী মনোভাব প্রায়ই দেখা যায়। এই অঞ্চলের জলপথ দিয়ে প্রতি বছর ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য পরিচালিত হয়।
এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের জন্য চীন প্রায়ই প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধে লিপ্ত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রীও চীনের এই সামরিক তৎপরতার সমালোচনা করেছেন। সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে তিনি বলেন, দক্ষিণ চীন সাগর এবং তাইওয়ানের আশেপাশে স্থিতাবস্থা পরিবর্তনে চীনের একতরফা প্রচেষ্টা গ্রহণযোগ্য নয়।
চীনের এই সামরিক তৎপরতা শুধু প্রথম দ্বীপপুঞ্জের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দ্বিতীয় দ্বীপপুঞ্জ, যা জাপানের হনশু দ্বীপ থেকে শুরু করে সাউথ প্যাসিফিকের গুয়াম পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানেও চীনের যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দিচ্ছে।
জাপানের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি জানিয়েছেন, চীন তাদের বিমানবাহী রণতরীর পরিচালনা ক্ষমতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।
এর মাধ্যমে তারা সমুদ্রের আরও দূরবর্তী অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করতে পারবে।
চীনের এমন সামরিক শক্তি প্রদর্শনের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ বাড়ছে। বিশ্লেষকদের মতে, চীন এখন একটি শক্তিশালী নৌ-সামরিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং তারা প্রয়োজনে এই শক্তি ব্যবহার করতে প্রস্তুত।
চীনের নতুন বিমানবাহী রণতরী ‘ফুজিয়ান’ এই পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি প্রায় ৮০ হাজার টন ওজনের এবং প্রায় ৫০টি যুদ্ধবিমান বহন করতে পারে।
এটি চীনের পুরনো জাহাজ ‘শ্যান্ডং’ এবং ‘লিয়াওনিং’-এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী।
তবে, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের নৌবাহিনীর সক্ষমতা এখনো যুক্তরাষ্ট্রের মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে এই অঞ্চলে সামরিক মহড়া পরিচালনা করে আসছে।
চীনের নৌবহর এখনো উন্নয়নের প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
তথ্য সূত্র: সিএনএন