কানাডার খ্যাতিমান আলোকচিত্রী এডওয়ার্ড বার্টিনস্কি, যিনি তাঁর ক্যামেরার মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে মানুষের তৈরি করা পরিবর্তনের চিত্র তুলে ধরেন, তাঁর কাজের এক বিশাল প্রদর্শনী হতে যাচ্ছে নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অফ ফটোগ্রাফিতে (আইসিপি)। “দ্য গ্রেট অ্যাক্সিলারেশন” শিরোনামের এই প্রদর্শনীতে স্থান পাবে ৭০টিরও বেশি ছবি, যেখানে শিল্পীর ক্যামেরাবন্দী করা বিভিন্ন স্থান, যেমন – খনি, কারখানা, এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের ছবি বিশেষভাবে প্রদর্শিত হবে।
বার্তিনস্কি, যিনি প্রায় পাঁচ দশক ধরে মানুষের কার্যকলাপের পৃথিবীর উপর প্রভাব নিয়ে কাজ করছেন, তাঁর ছবিতে মানুষের কর্মকাণ্ডের এক বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। তাঁর ছবিগুলো দর্শকদের একদিকে যেমন পরিচিত পৃথিবীর বাইরে নিয়ে যায়, তেমনই আবার সেই সব অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের গভীর সম্পর্কগুলোও তুলে ধরে, যা সাধারণত আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে।
উদাহরণস্বরূপ, কানাডার একটি নিকেল খনির কাছে কমলা রঙের একটি জলধারা, যা একইসঙ্গে সুন্দর এবং বিষাক্ত, অথবা বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে পুরাতন জাহাজের ধ্বংসাবশেষের ছবিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বার্তিনস্কি তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জানান, ১৯৭৬ সালে তিনি যখন প্রথম ফটোগ্রাফি ক্লাসে যোগ দেন, তখন তাঁর শিক্ষক তাঁকে ‘মানুষের প্রমাণ’ (evidence of man) –এরকম একটি বিষয় নিয়ে ছবি তোলার কথা বলেছিলেন। সেই কাজটি যেন তাঁকে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করে।
এরপর তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ছবি তুলেছেন, যেখানে মানুষের তৈরি করা বিভিন্ন স্থাপনা, শিল্পকর্ম, এবং পরিবেশের পরিবর্তন সুস্পষ্টভাবে দৃশ্যমান।
বার্তিনস্কির ছবিগুলোতে মানুষের কার্যকলাপ স্পষ্টভাবে দেখা গেলেও, ছবিতে মানুষের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম। তিনি মূলত মানুষের সম্মিলিত প্রয়াসের প্রভাবগুলো ক্যামেরাবন্দী করতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “প্রকৃতিকে আমরা যেভাবে দেখি, মানুষও এখন সেভাবে প্রভাব বিস্তার করছে।
আমরা নিজেরাই যেন এক বিশাল শক্তি হয়ে উঠেছি, যা পৃথিবীকে পরিবর্তন করে চলেছে।”
এই প্রদর্শনীতে, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের (ডিআরসি) একটি খনির ছবিও স্থান পেয়েছে। যেখানে শুকনো বর্জ্য পদার্থ (tailings) জমা করা হয়।
এই বর্জ্যের মধ্যে মূল্যবান কোবাল্ট থাকে, যা স্মার্টফোন সহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তির জন্য অপরিহার্য। স্থানীয় মানুষজন এখান থেকে কোবাল্ট সংগ্রহ করে বিক্রি করে।
বার্তিনস্কি মনে করেন, এই ছবিগুলো আমাদের সেই সব জায়গার সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করে, যা হয়তো আমাদের দৃষ্টির বাইরে, কিন্তু আমরা প্রতিদিনের জীবনে তাদের সঙ্গে জড়িত।
বার্তিনস্কির ছবিতে খনি সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি নিজেও একসময় খনি শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর মতে, খনি হলো এমন একটি জায়গা, যেখানে প্রতিদিনের সাধারণ জিনিসকে মূল্যবান করে তোলা হয়।
তাঁর এই ভাবনা থেকেই তিনি বিভিন্ন কারখানায়, পাওয়ার প্ল্যান্টে এবং বাঁধের ছবি তুলেছেন।
লস অ্যাঞ্জেলেসের ভয়াবহ দাবানলের ছবি তোলার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, সেখানকার বাতাসের তীব্রতা ছিল কল্পনাতীত। তিনি বলেন, এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরও বেশি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে।
বার্তিনস্কির কাজের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, তিনি এডওয়ার্ড ওয়েস্টন, আনসেল অ্যাডামস, এবং ক্যাসপার ডেভিড ফ্রিডরিখের মতো শিল্পীদের কাজ পছন্দ করেন।
তাঁর মতে, ছবি তোলার ক্ষেত্রে রঙের ব্যবহার, আলো এবং কাঠামোর দিকে মনোযোগ দিতে হয়।
বর্তমানে ড্রোন শটের আধিক্যের কারণে ছবি তোলা কি কঠিন হয়ে পড়ছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন ছবি তোলার সংখ্যা অনেক বেড়েছে, তবে এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল একটি অর্থ তৈরি করা এবং গল্প বলা।
এডওয়ার্ড বার্টিনস্কির এই প্রদর্শনী, “দ্য গ্রেট অ্যাক্সিলারেশন”, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উৎসাহিত করে। তাঁর কাজ, আমাদের পরিবেশের উপর মানুষের প্রভাব সম্পর্কে সচেতন করে তোলে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য আমাদের করণীয় সম্পর্কেও ধারণা দেয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও, পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় বার্টিনস্কির ছবিগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক