স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর দিকে আমাদের আগ্রহ সবসময়ই বেশি থাকে, কিন্তু ভুলে যাওয়াটাও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ দক্ষতা, সে কথা কয়জনই বা ভাবি? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে মনোবিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু বিষয় ভুলে যাওয়ার ক্ষমতা আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য, সৃজনশীলতা এবং আত্ম-উপলব্ধির জন্য জরুরি।
ছোটবেলার কথা ভাবুন তো! হয়তো কোনো বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল, যা আপনাকে খুব কষ্ট দিয়েছিল। সেই ঘটনার কথা মনে পড়লে আজও হয়তো মন খারাপ হয়। আবার এমন অনেক স্মৃতি আছে যা হয়তো সময়ের সাথে সাথে হালকা হয়ে গেছে, বা আপনি ভুলেই গিয়েছেন।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা আমাদের মনকে অপ্রয়োজনীয় তথ্য আর মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়।
আসলে, ভুলে যাওয়াটা সবসময় আমাদের ইচ্ছায় হয় না। যখন আমরা কোনো বিষয়ে মনোযোগ দিই না, বা যে তথ্যগুলো আমাদের দরকার নেই, সেগুলো ধীরে ধীরে মন থেকে মুছে যায়। যেমন ধরুন, চাবিটা কোথায় রেখেছেন, সেদিকে খেয়াল না করলে, পরে খুঁজে বের করতে সমস্যা হয়।
তবে, বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন, আমরা চাইলে কিছু বিষয়কে ভুলতে পারি। এই ইচ্ছাকৃত ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি আমাদের ভালো থাকতে সাহায্য করতে পারে।
ধরুন, একটি অনুষ্ঠানে আপনি সবার সামনে গান গাইতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেললেন। বিষয়টি নিশ্চয়ই বিব্রতকর ছিল। এখন যদি আপনি বন্ধুদের সাথে এই বিষয়ে কথা বলার সময়, গান গাওয়ার সময়কার ভুলগুলো এড়িয়ে যান, তাহলে ধীরে ধীরে সেই খারাপ স্মৃতিগুলো ফিকে হয়ে আসবে।
হয়তো আপনি বরং ভালো করে গান গাওয়ার স্মৃতিগুলো মনে করবেন, বন্ধুদের হাসাহাসি বা আপনার আঘাত পাওয়ার ঘটনাগুলো ভুলে যাবেন। মনোবিজ্ঞানী জোনাথন ফসেটের মতে, “আমরা যখন সচেতনভাবে কিছু বিষয় মনে রাখি এবং কিছু বিষয় এড়িয়ে যাই, তখন আসলে নিজেদের ভেতরের গল্পটাকেই বদলে দিই।”
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যামব্রিজের মনোবিজ্ঞানী মাইকেল অ্যান্ডারসন ‘think, no-think’ নামক একটি পরীক্ষা করেছেন। যেখানে অংশগ্রহণকারীদের কিছু শব্দ-জোড়া মনে রাখতে বলা হয়। এরপর তাদের একটি শব্দ দেখে, অন্য শব্দটি মনে করতে অথবা মনে করতে নিষেধ করা হয়।
দেখা গেছে, যারা কোনো শব্দ মনে করতে চেষ্টা করেনি, তাদের সেই শব্দটি মনে করার প্রবণতা কমে গেছে। অ্যান্ডারসন এই প্রক্রিয়াটিকে শারীরিক ক্রিয়া বন্ধ করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। যেমন, গরম কড়াই ধরলে যেমন হাত সরিয়ে নিই, তেমনই কোনো খারাপ স্মৃতিকে মন থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়।
সম্প্রতি, কোভিড-১৯ অতিমারীর সময় উদ্বেগের কারণ হওয়া কিছু স্মৃতিকে ভুলতে পারার ওপর একটি গবেষণা হয়েছে। এই গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের কিছু কথা মনে রাখতে বলা হয়, যা তাদের উদ্বেগের কারণ ছিল। এরপর তাদের হয় সেই স্মৃতিগুলো মনে করতে, না হয় মনে করতে নিষেধ করা হয়।
তিন দিনের প্রশিক্ষণের পর, যাদেরকে কিছু মনে করতে নিষেধ করা হয়েছিল, তারা অন্যদের চেয়ে কম উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিন মাস পরেও তাদের স্মৃতিগুলো আগের মতো বিরক্তিকর ছিল না। এমনকি ৮০ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তারা এখনো এই কৌশল ব্যবহার করেন।
স্মার্টফোন আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু এর কিছু নেতিবাচক দিকও আছে। ফোন আমাদের পুরনো ছবি বা ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়, যা আমরা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম। এই ধরনের ‘নতুন’ স্মৃতিগুলো একদিকে যেমন ভালো, তেমনই অতীতের কিছু কষ্টের স্মৃতিকে আবার সামনে নিয়ে আসতে পারে।
তাই স্মৃতিকে উন্নত করার পাশাপাশি, ভুলে যাওয়ার কৌশলগুলোও আমাদের জন্য খুব দরকারি।
ভুলে যাওয়া হয়তো কোনো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ জেতার মতো বিষয় নয়, কিন্তু এটি আমাদের জীবনের একটি অংশ। এটি আমাদের মানসিক চাপ কমাতে, সৃজনশীল হতে এবং আত্ম-উপলব্ধি বাড়াতে সাহায্য করে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক