ভুলে যাওয়া কি সম্ভব? – নিউরোবিজ্ঞানীর নতুন গবেষণা
আমাদের জীবনের সুখ-দুঃখের স্মৃতিগুলো যেন এক একটি মূল্যবান সম্পদ। কখনও হাসিখুশি মুহূর্ত, আবার কখনও গভীর বেদনার স্মৃতি—এগুলোই তো মানুষ হিসেবে আমাদের পরিচয় গড়ে তোলে।
কিন্তু যদি এমন হতো, চাইলেই কিছু অপ্রয়োজনীয় স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলা যেত? অথবা, খারাপ কোনো স্মৃতিকে বদলে দেওয়া যেত ভালো স্মৃতিতে? সম্প্রতি, বিজ্ঞানীরা এমনই এক অত্যাশ্চর্য গবেষণা নিয়ে কাজ করছেন, যা আমাদের স্মৃতি এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির নিউরোবিজ্ঞানী এবং ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এক্সপ্লোরার স্টিভ রামিরেজ (Steve Ramirez)-এর নেতৃত্বে চলছে এই গবেষণা। মানুষের স্মৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে তাঁর কাজ ইতিমধ্যেই সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
মূলত ইঁদুরের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের স্মৃতি তৈরি এবং তা পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছেন। রামিরেজের দল দেখিয়েছেন, তাঁরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে মিথ্যা স্মৃতি তৈরি করতে পেরেছেন।
এই গবেষণা একদিকে যেমন কৌতূহলোদ্দীপক, তেমনই ভবিষ্যতে মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে।
রামিরেজের গবেষণা মূলত স্মৃতিকে ‘পরিবর্তনযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করে। আমাদের স্মৃতিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়।
প্রতিটি স্মৃতির পুনরুদ্ধার আমাদের মস্তিষ্কে নতুন করে কিছু পরিবর্তন আনে। অনেকটা ‘সেভ অ্যাজ’ অপশন ব্যবহার করার মতো, প্রতিবার স্মৃতি মনে করার সময়, এটি সামান্য হলেও পরিবর্তিত হয়।
বিজ্ঞানীরা এখন এই ‘পরিবর্তনশীলতা’কে কাজে লাগিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে স্মৃতিগুলোকে নতুন রূপ দিতে চাইছেন।
গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে, বিজ্ঞানীরা ইঁদুরের মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু নিউরনের কার্যকলাপ চিহ্নিত করেন, যা ভয়ের স্মৃতি তৈরি করতে সহায়ক। এই নিউরনগুলোকে আলো সংবেদনশীল করে তৈরি করা হয়।
এরপর, ইঁদুরগুলোকে একটি বাক্সে রেখে সামান্য বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়, যার ফলে তাদের মধ্যে ভয়ের স্মৃতি তৈরি হয়। বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে, মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম অপটিক্যাল ক্যাবল স্থাপন করে লেজার রশ্মির মাধ্যমে সেই ভয়ের স্মৃতিকে সক্রিয় করেন।
আশ্চর্যজনকভাবে, বিজ্ঞানীরা এরপর ইঁদুরগুলোকে এমন একটি বাক্সে রাখেন যেখানে তাদের কোনো আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তবে লেজার রশ্মি ব্যবহার করে আগের ভয়ের স্মৃতি জাগিয়ে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই তারা সামান্য শক অনুভব করে।
ফলে, যে বাক্সে তাদের কোনো আঘাত লাগেনি, সেখানেও তারা ভয় পেতে শুরু করে। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা সফলভাবে ইঁদুরের মধ্যে একটি মিথ্যা ভয়ের স্মৃতি তৈরি করতে সক্ষম হন।
রামিরেজ মনে করেন, মানুষের ক্ষেত্রেও স্মৃতিকে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মানুষের জন্য এই প্রক্রিয়াটি আরও সহজ এবং কম আক্রমণাত্মক হবে।
উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তির আনন্দপূর্ণ স্মৃতিকে সক্রিয় করতে, তাঁকে সেই স্মৃতি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করাই যথেষ্ট হতে পারে।
এই গবেষণার বাস্তব প্রয়োগ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, তাঁদের এই গবেষণা ভবিষ্যতে মানসিক আঘাতজনিত সমস্যা (PTSD), আলঝাইমার্স এবং ডিমেনশিয়ার মতো স্মৃতি-সম্পর্কিত রোগ নিরাময়ে সাহায্য করবে।
তাঁদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হলো, মস্তিষ্কের ‘স্মৃতি মানচিত্র’ তৈরি করা, যা স্মৃতি তৈরি হওয়ার স্থান চিহ্নিত করতে পারবে। এর মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা রোগের শুরুতেই তা শনাক্ত করতে এবং চিকিৎসা করতে সক্ষম হবেন।
যদিও এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, তবে এটি নিঃসন্দেহে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। নিউরোবিজ্ঞানের এই অগ্রযাত্রা একদিন আমাদের স্মৃতিগুলোকে আরও ভালোভাবে বুঝতে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করতে সাহায্য করবে।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক