স্মৃতি: সবকিছু মনে রাখা, নাকি কিছুই না মনে রাখা?
আমাদের মস্তিষ্ক এক বিশাল রহস্যময় জগৎ। এর ক্ষমতা সীমাহীন, আর এর জটিলতা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। মানুষের স্মৃতিশক্তিও এই মস্তিষ্কের এক অসাধারণ ক্ষমতা। কেউ হয়তো শৈশব থেকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মনে রাখতে পারে, আবার কারো স্মৃতিশক্তি এতটাই দুর্বল যে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাও তার মনে থাকে না।
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের একটি প্রতিবেদনে স্মৃতিশক্তির এই দুই চরম রূপের গল্প তুলে ধরা হয়েছে। চলুন, সেই গল্পগুলো থেকে আমরা স্মৃতি ও বিস্মৃতির জগৎটা একটু ঘুরে আসি।
ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা ৪১ বছর বয়সী এ.জে. (ছদ্মনাম)-এর কথা ভাবুন। তিনি হাইপারথাইমেস্টিক সিন্ড্রোমে আক্রান্ত। এই বিরল condition-এর কারণে তিনি তার জীবনের ১১ বছর বয়স থেকে প্রতিটি দিনের কথা স্পষ্ট মনে করতে পারেন।
১৯৮৬ সালের ৩রা আগস্ট, দুপুর ১২টা ৩৪ মিনিটে তার ক্রাশ করা ছেলেটি তাকে ফোন করেছিল, সেই মুহূর্তটিও তার মনে আছে। ১৯৯২ সালের ২৮শে মার্চ বাবার সঙ্গে বেভারলি হিলস হোটেলে দুপুরের খাবার খাওয়ার কথাও তার স্মৃতিতে অমলিন। বিশ্বজুড়ে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা, এমনকি মুদি দোকানে কেনাকাটার খুঁটিনাটি পর্যন্ত তার মনে আছে।
যেন একটি চলমান সিনেমার মতো, তার স্মৃতি অবিরাম ছুটে চলে।
অন্যদিকে, ৮৫ বছর বয়সী ই.পি. (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি, যিনি পেশায় ছিলেন ল্যাব টেকনিশিয়ান। তার স্মৃতিশক্তি এতটাই দুর্বল যে, তিনি কেবল তার সাম্প্রতিক চিন্তাগুলোই মনে রাখতে পারেন। ১৫ বছর আগে হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস তার মস্তিষ্কের ক্ষতি করে, যার ফলে তার স্মৃতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
অতীতের অনেক কিছুই এখন তার কাছে অস্পষ্ট।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের স্মৃতি ধারণের প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল। স্মৃতি আসলে মস্তিষ্কের নিউরনের মধ্যে তৈরি হওয়া সংযোগের একটি বিন্যাস। আমাদের মস্তিষ্কে প্রায় ১০০ বিলিয়ন নিউরন রয়েছে, আর প্রতিটি নিউরন অন্য নিউরনের সঙ্গে প্রায় ৫,০০০ থেকে ১০,০০০ সংযোগ তৈরি করতে পারে।
প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে, আমাদের চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে এই সংযোগগুলো পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তনগুলোই স্মৃতি তৈরি করে।
ই.পি.-র ক্ষেত্রে, মস্তিষ্কের যে অংশটি স্মৃতি তৈরি করতে সাহায্য করে, সেই হিপোক্যাম্পাস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার পক্ষে নতুন স্মৃতি তৈরি করা সম্ভব হয় না। একইসঙ্গে, পুরনো অনেক স্মৃতিও তিনি মনে রাখতে পারেন না।
তিনি নতুন কোনো স্মৃতি তৈরি করতে পারেন না, আবার ১৯৬০ সালের আগের কোনো ঘটনাও তার মনে নেই।
আশ্চর্যজনকভাবে, ই.পি.-র বুদ্ধিমত্তার কোনো অভাব নেই। তিনি সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন এবং সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই বুঝতে পারেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি সেই কথাগুলো ভুলে যান।
বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে স্মৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন। এক্ষেত্রে তারা ই.পি.-র মতো রোগীদের মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছেন। এই গবেষণায় দেখা গেছে, স্মৃতি দুই ধরনের: ডিক্লারেটিভ এবং নন-ডিক্লারেটিভ।
ডিক্লারেটিভ স্মৃতি হলো, যা আমরা সচেতনভাবে মনে করি, যেমন- কোনো ঘটনার তারিখ বা কোনো ব্যক্তির নাম। আর নন-ডিক্লারেটিভ স্মৃতি হলো, যা আমরা অজান্তেই শিখে যাই, যেমন- সাইকেল চালানো বা কোনো কাজ করার কৌশল।
মেমোরি প্যালেস বা স্মৃতি প্রাসাদ:
প্রাচীনকালে, যখন বই সহজলভ্য ছিল না, তখন মানুষ স্মৃতিকে কাজে লাগিয়ে জ্ঞান অর্জন করত। তারা একটি বিশেষ কৌশল ব্যবহার করত, যা ‘মেমোরি প্যালেস’ নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে, কোনো তথ্যকে মনে রাখার জন্য দৃশ্যমান চিত্র তৈরি করা হতো এবং সেগুলোকে একটি কল্পিত স্থানে সাজানো হতো।
ইতালীয় আইনজ্ঞ পিটার অফ রাভেনা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বাইবেল, বিভিন্ন আইন এবং অনেকগুলো বিখ্যাত বক্তৃতা মুখস্থ করেছিলেন।
স্মৃতি-বর্ধক ঔষধ:
বর্তমান যুগে, আমরা তথ্য সংরক্ষণের জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করি। ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা, সময় দেখার জন্য ঘড়ি, আর প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে রাখার জন্য আমাদের হাতে স্মার্টফোন রয়েছে। তবে, স্মৃতি দুর্বল হয়ে গেলে অনেকেই স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য ঔষধের সাহায্য নেন।
বিজ্ঞানীরা স্মৃতিশক্তি বাড়ানোর জন্য নতুন ঔষধ তৈরি করার চেষ্টা করছেন। তারা এমন কিছু রাসায়নিক উপাদান নিয়ে কাজ করছেন, যা মস্তিষ্কের স্মৃতি তৈরি এবং পুনরুদ্ধারের ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
এ.জে.-র মতো সবকিছু মনে রাখতে পারা, নাকি ই.পি.-র মতো কিছুই মনে রাখতে না পারা – এই দুইয়ের মাঝে আসলে কোনটি ভালো?
এ.জে.-র জন্য, সবকিছু মনে রাখাটা যেমন আনন্দের, তেমনি কষ্টের। কারণ, তিনি জীবনের খারাপ অভিজ্ঞতাগুলোও ভোলেন না। অন্যদিকে, ই.পি.-র কোনো স্মৃতি না থাকায় তিনি বর্তমানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। হয়তো অতীতের কোনো দুঃখ বা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তা তাকে স্পর্শ করে না।
আসলে, আমাদের মস্তিষ্ক বর্তমান এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে চায়। তাই স্মৃতি তৈরি এবং বিস্মৃতির এই খেলা চলে। হয়তো, কিছু ভুলে যাওয়াই আমাদের জীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।
তথ্য সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক