আমাদের স্মৃতিশক্তির সঙ্গে ইন্দ্রিয়গুলির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। কোনো পরিচিত গন্ধ, পুরোনো গান, অথবা প্রিয় কোনো দৃশ্যের স্মৃতি হঠাৎ করেই যেন আমাদের মনকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
ফ্রান্সে লেখক মার্সেল প্রুস্ত-এর উপন্যাসে বর্ণিত একটি ঘটনার কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি তার লেখায় তুলে ধরেছিলেন, কিভাবে একটি ‘মাদেলেইন’ নামক কেক-এর স্বাদ তাকে শৈশবের স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।
এই ঘটনার সূত্র ধরেই মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলি স্মৃতি তৈরি এবং তাকে ধরে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
বোস্টন ইউনিভার্সিটির স্নায়ুবিজ্ঞানের অধ্যাপক অ্যান্ড্রু বুডসন-এর মতে, “যখন আমরা কোনো দৃশ্য দেখি, শব্দ শুনি বা কোনো গন্ধ পাই, তখন আমাদের স্নায়ুগুলি সক্রিয় হয়ে ওঠে।
এই সংকেতগুলি মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাসে পৌঁছে স্মৃতি তৈরি করে।
হিপোক্যাম্পাস, যা স্মৃতি প্রক্রিয়াকরণের প্রধান কেন্দ্র, সেই মুহূর্তে দেখা, শোনা, বা অনুভব করা বিভিন্ন বিষয়কে একত্রিত করে একটি স্মৃতি তৈরি করে।
এর সঙ্গে, মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামক অংশটি সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে আবেগ যোগ করে, যা দীর্ঘকাল ধরে স্মৃতিটিকে মনে রাখতে সাহায্য করে।
তাহলে, কিভাবে আমরা আমাদের স্মৃতিশক্তি আরও শক্তিশালী করতে পারি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলিকে কাজে লাগিয়ে আমরা এই ক্ষমতা বাড়াতে পারি।
আসুন, জেনে নিই স্মৃতিশক্তির ওপর ইন্দ্রিয়গুলির প্রভাব এবং তাদের প্রশিক্ষণের কিছু উপায়:
দৃষ্টিশক্তি: দৃষ্টিশক্তি আমাদের সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্দ্রিয়গুলির মধ্যে একটি।
আমরা যা দেখি, তার অনেক কিছুই আমাদের মনে গেঁথে থাকে।
কোনো দৃশ্যের খুঁটিনাটি, যেমন রং এবং টেক্সচারের দিকে মনোযোগ দিলে সেই স্মৃতি আরও ভালোভাবে মনে রাখা যায়।
ধরুন, আপনি একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখছেন।
সেটির ঘাস, ফুল, পাখির রঙ, মেঘের আকার—এসবের দিকে মনোযোগ দিন।
এই মনোযোগ আপনাকে স্মৃতিগুলি মনে রাখতে সাহায্য করবে।
শ্রবণশক্তি: শ্রবণশক্তিও আমাদের স্মৃতি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কোনো গান, যা আপনার জীবনের বিশেষ একটি মুহূর্তে বাজছিল, তা আজও হয়তো আপনার মনে আছে।
কোনো প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর অথবা কোনো ঘটনার সঙ্গে জড়িত শব্দ, যা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেগুলিও স্মৃতিতে গেঁথে থাকে।
গানের সুর মনে রাখার জন্য চেষ্টা করুন গানের বিভিন্ন অংশকে আলাদাভাবে শোনার।
বাদ্যযন্ত্রগুলির শব্দ আলাদাভাবে উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
ঘ্রাণশক্তি: ঘ্রাণশক্তি স্মৃতিকে জাগ্রত করার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকরী।
পরিচিত কোনো গন্ধ, যেমন—শীতকালে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের সুবাস, বর্ষায় কদম ফুলের গন্ধ, কিংবা ঈদের সময় সেমাইয়ের ঘ্রাণ—আমাদের পুরনো স্মৃতিগুলিকে ফিরিয়ে আনতে পারে।
ব্রাউন ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল স্কুলের স্নায়ুবিজ্ঞানী র্যাচেল হার্জ বলেন, “ঘ্রাণ মস্তিষ্কের সেই অংশের সঙ্গে যুক্ত, যা আবেগ, শিক্ষা এবং স্মৃতির সঙ্গে জড়িত।
আপনার চারপাশে থাকা বিভিন্ন জিনিসের গন্ধ, যেমন—রান্নার মশলা, সুগন্ধী, মোমবাতি—এগুলির প্রতি মনোযোগ দিন।
গন্ধগুলি আপনাকে কীসের কথা মনে করায়, তা অনুভব করার চেষ্টা করুন।
স্বাদ গ্রহণ: খাবার, যা আমরা খাই, তার স্বাদও আমাদের স্মৃতিতে প্রভাব ফেলে।
কোনো বিশেষ খাদ্য, যা আপনি আগে খেয়েছেন, তার স্বাদ মনে করার চেষ্টা করুন।
খাদ্যটি কিভাবে আপনার মুখে লেগেছিল, তার বর্ণনা দিন।
বিভিন্ন ধরনের খাবারের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করুন এবং তাদের মধ্যেকার পার্থক্যগুলো অনুভব করুন।
স্পর্শ: স্পর্শের মাধ্যমেও আমরা অনেক স্মৃতি তৈরি করি।
কোনো বস্তুর স্পর্শ—যেমন, ঠান্ডা পাথরের অনুভূতি, নরম কাপড়ের আরাম—আমাদের মনে গেঁথে থাকে।
এই ধরনের স্মৃতিগুলি ধরে রাখতে বিভিন্ন ধরনের বস্তুর সাথে খেলা করতে পারেন।
যেমন—ধান, চাল, বা শুকনো মটরশুঁটি হাতে নিয়ে তাদের অনুভব করতে পারেন।
আমাদের স্মৃতিশক্তিকে শক্তিশালী করতে হলে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির প্রতি মনোযোগ দিতে হবে।
চারপাশে যা ঘটছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শ্বাস-প্রশ্বাস এর ওপর মনোযোগ স্থাপন করে, আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা স্মৃতিকে আরও শক্তিশালী করতে পারি।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক